উর্দু সাহিত্য ও ফয়েজ আহমদ ফয়েজ – সৌম্য ঘোষ
তুর্কি, পাঠান, মোঘল শাসন কালে ভারতীয় সংস্কৃতি নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন দেশি বিদেশী ভাষার সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে নতুন একটি ভাষা এগারো শতক বা তারও আগে থেকে রূপ নিতে শুরু করলেও সেই ভাষা ‘উর্দু’ নামে চিহ্নিত হয় অনেক পরে। উর্দুর ব্যাকরণগত কাঠামো ভারতীয়। উত্তর ভারতের অন্যান্য ভাষার মতো উর্দু পশ্চিমী শৌরসেনী অপভ্রংশ থেকে জাত।তার শব্দভাণ্ডারে ঢুকেছে অজস্র ফার্সি, আরবি, তুর্কি শব্দ। ধ্বনিবহুল জমকালো শব্দগুলো আরবি থেকে নেওয়া। আর উর্দুর লালিত্যে আছে ফার্সির দান। কবিগুরুর ভাষায়:
“উর্দু ভাষায় যতই পারসি এবং আরবি শব্দ থাক না তবু ভাষাতত্ত্ববিদগণ জানেন তাহা ভারতবর্ষীয় গৌড়ীয় ভাষারই এক শ্রেণী; ভাষার প্রকৃতিগত যে কাঠামোটাই তাহার নিত্যসামগ্রী, যে কাঠামোকে অবলম্বন করিয়া সৃষ্টির কাজ চলে, সেটা বিদেশি সামগ্রীতে আদ্যোপান্ত সমাচ্ছন্ন হইয়া তবুও গৌড়ীয়।’’
বাংলায় হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বর একইভাবে উচ্চারিত হয়। কিন্তু উর্দুতে তাদের মাত্রাভেদ স্পষ্ট।সব মিলিয়ে বিচিত্র ব্যঞ্জনায় উর্দু খুব শ্রুতিমধুর ভাষা। পরবর্তীকালে রাজদরবারে লালিত হওয়ার দরুণ এর শব্দাবলী ও বাগভঙ্গীও পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত। তবে রাজানুকূল্য পেতে উর্দুকে বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন ফার্সির একাধিপত্য চলছে অভিজাত মননের মহলে মহলে। রাজদরবারে ফার্সিতেই সাহিত্য করতেন ওই সময়কার কবিগণ। যোগাযোগের একটি উল্লেখযোগ্য ভাষা হিসাবে ততদিনে উর্দু নিজেকে সাবালক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তুলতে সামর্থ্য অর্জন করে নিলেও কবিতা ইত্যাদি উচ্চমার্গের সাধনায় গৌরবের আসন নিতে পারেনি। অখ্যাত প্রায় কবি ওয়ালিদকনি প্রমাণ করে দিলেন যে, সাধারণ মানুষের মুখের গতিশীল উর্দুতেও ফার্সির সমতুল্য কবিতা লেখা যায়। তা দেখে দিল্লীর দরবারের যশপ্রার্থী তরুণ কবিরাও উর্দুর প্রতি আগ্রহ বোধ করলেন। উঠে আসতে লাগলেন একের পর এক প্রতিভাবান সব কবি, যাঁদের নাম উর্দু সাহিত্যের সাম্রাজ্যে আজও নক্ষত্রের মতো জ্বল জ্বল করে। উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম উল্লেখযোগ্য কবির নাম মীর তকি মীর। মধ্য এশিয়া থেকে আসা তুর্কি, পাঠান, মোঘল প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের সংযোগ থেকে জন্ম হয়েছিলো উর্দু ভাষার। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের জন্য এক আটপৌরে সম্পর্ক-ভাষা হিসাবে এর সৃষ্টি। এর গায়ে সৈনিক শিবিরের গন্ধ লেগে আছে। সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে উর্দুর ঐতিহাসিক বিস্তৃতি ঘটেছিলো। ১৮৫৭-এর পর উর্দুর ভাগ্যে প্রথম ট্র্যাজেডি ঘনিয়ে আসে রাজা আর রাজদরবারের বিলুপ্তির সাথে সাথে অভিজাতদের ইংরেজি মুখিনতায়।
উর্দু রাজদরবারের গৌরবময় সাহিত্যিক ভাষা হয়ে ওঠার মানে সংস্কৃতের মতো এর অবস্থা নির্দেশ করে না। যেহেতু সাধারণ মানুষের যোগাযোগের ভাষা থেকে এই ভাষার সাহিত্যকে অভিজাতদের মাঝে স্থান করে নিতে হয়েছিলো, এই কারণে উর্দু সাহিত্যের রসাস্বাদনে আপামরের প্রবেশাধিকার অক্ষুণ্ন ছিলো এবং তা এখনো যে নেই তা নয়। তবে এর চর্চা ভালোরকমের করে জাঁকিয়ে বসেছিলো দরবারকে কেন্দ্র করে। গজলে গজলে দরবারগুলো বারাবরই জমিয়ে রাখা হতো। উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে ঈর্ষণীয় সম্পদ হল এর গজলের ভাণ্ডার।
মায়াকোভস্কি, পাবলো নেরুদা, পল এলুয়ার, লুই আরাগঁ, নাজিম হিকমতদের একসারিতে ফয়েজকে রাখার যে কারণ, তা ফয়েজের কাব্য ও জীবনেই খুঁজে পাওয়া যাবে। ইকবাল-উত্তর যুগের সবচেয়ে প্রতিভাবান উর্দু কবি ফয়েজ তার বলিষ্ঠ সমাজ ভাবনা প্রকাশ করার জন্য গজলের সুমধুর ভাষা-শৈলী এবং চিত্রকল্পের সাহায্য নিয়েছেন। এই অর্থে ব্যাপারটাকে তাঁর সমাজ ভাবনা বলা অসঙ্গত নয় যে, ফয়েজ তাঁর ব্যক্তিক অনুভবের সাথে সমষ্টি চেতনাকে সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে যা মহৎ সৃষ্টি। ফয়েজের ‘আমি’ এবং ‘আমরা’ পরস্পরবিরোধী দুই সত্ত্বা নয়। তাঁর এই উপলব্ধি তাঁকে উর্দু সাহিত্যের নতুন যুগের স্রষ্টার মর্যাদা দান করেছে গালিবের মতোই। ‘চাক গরেবাঁ’ দ্বারা ঐতিহ্যগতভাবে গজলে বোঝানো হয়ে থাকে আত্মভোলা ব্যাকুল প্রেমিককে, যার পোশাক-আশাকের দিকেও নজর দেওয়ার মতো মনের অবস্থা নেই। ফয়েজ এই শব্দবন্ধের সঞ্চারণ করেছেন প্রাণ উৎসর্গীকৃত বিপ্লবীদের অভিধায়। গজলের নতুন নির্মাণে এরকমটি অজস্রবার করেছেন ফয়েজ, অথচ ঐতিহ্যের সাথে সংঘর্ষ না ঘটিয়ে।
“বসন্তের সম্ভাবনা কোথাও তো উঠেছে ফুঁটে
ফুল বাগানে কিছু বসন তো অন্তত ছিন্ন হয়েছে
এখনো হেমন্তের রাজত্ব, তবু কোথাও কোথাও
উদ্যানের পথের নির্জন কোণে শুরু তো হয়েছে গজল গাওয়া
মরু এখনো মরু, তবু পায়ের রক্তে ‘ফয়েজ’
কয়েকটি কাঁটা তো ভিজে হয়েছে কোমল”
(আগস্ট ১৯৫২)
শিল্প-ব্যাপারে ফয়েজের মত প্রকাশ পেয়েছে তাঁর এই অভিজ্ঞানেঃ
“আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, মানুষের সম্মিলিত সংগ্রামকে পূর্ণ মাত্রায় উপলব্ধি করে সেই সংগ্রামে অংশ নেওয়ার সজ্ঞান প্রচেষ্টা কেবলমাত্র জীবনের দাবি নয়, শিল্পেরও দাবি। শিল্প জীবনেরই এক অংশ এবং শৈল্পিক প্রয়াস সেই সংগ্রামের একটি রূপ মাত্র। শিল্পীর কাছে এই দাবি চিরন্তন। তাই শিল্পীর সংগ্রামের কোন সমাপ্তি নেই। শিল্পীর এই প্রচেষ্টার সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে তাঁর ক্ষমতার উপর। কিন্তু এই প্রচেষ্টার সাথে অক্লান্তভাবে যুক্ত থাকা শুধু সম্ভবই নয়, অত্যন্ত জরুরি। আমার কবিতাও এমনই এক প্রচেষ্টার ফল।”
“এই কাগজ কলমের পরিচর্যা করে যাব আমি
যা কিছু সয়েছে এই হৃদয় সব লিখে যাব আমি
প্রেমের বেদনার উপকরণ সঙ্গে রেখে যাব
কালের ঊষরতাকে কৃপা করে যাব আমি
এই দিন-রাত্রির তিক্ততা আরো বাড়বে জানি
জানি শোষকও চালিয়ে যাবে শোষণের খেলা
মানলাম এই তিক্ততা, সইতে পারি এই নির্যাতন
প্রাণ থাকে যদি জগত-দুঃখের প্রতিবিধান করে যাব আমি
পানশালা যদি অটুট থাকে তবে রক্তিম মদিরায়
পবিত্র গৃহের দেয়াল দরোজা সাজিয়ে যাব আমি
হৃদয়ে যদি বাকি থাকে রক্ত, তবে প্রতি বিন্দু অশ্রু দিয়ে
আমার প্রতিমার ঠোঁট, চিবুকের জন্য রঙ তৈরি করে যাব আমি
তাদের নির্বিকারের খেলা তাদেরই থাক
বাসনার যে দাবি, সে আমি জানিয়েই যাব”
(কাগজ কলম)
ভারতের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের বিবেচনায় উর্দু সাহিত্যে কবিতার জনপ্রিয়তা বেশি। মুশায়েরায় উর্দু কবিরা যেরকম সংবর্ধনা পান তা অন্যদের কাছে ঈর্ষণীয়। এই প্রিয়তার মূলে আছে এক শুদ্ধ ঐতিহ্য। কবি ও পাঠকের অন্তরঙ্গতা। প্রথমদিকে ফয়েজ যেসব কবিতা লিখেছেন সেগুলো গজলের ধারা মেনেই যথারীতি বিলাপে ভরা ।
“নিঃসঙ্গতা আজ কোন পুরনো বন্ধুর মতো
আমার পান পাত্র পূর্ণ করতে এসেছে সন্ধ্যা ঢলতে
আমরা দু’জনই বসে আছি অপেক্ষায় কখন উঠবে
কখন প্রতিটি ছায়ার তলে ঝলমল করবে তোমার প্রতিচ্ছবি”
(নিঃসঙ্গতা)
গোড়ার পর্ব কেটে যেতেই প্রেম-বিরহের গতানুগতিক পথ ছেড়ে জীবনের বৃহত্তর উপলব্ধির মুখোমুখি হলেন ফয়েজ।
“এখনো হৃদয় ভুলানো সৌন্দর্য তোমার, কিন্তু কী করব
প্রেমের দুঃখ ছাড়া আরো দুঃখ আছে জগতে
জগতে আরো প্রশান্তি আছে মিলনের প্রশান্তি ছাড়া
আগের মতো ভালোবাসা আমার কাছে চেয়ো না প্রিয়”
(আগের মতো ভালোবাসা আমার কাছে চেয়ো না প্রিয়)
ফয়েজের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন এই ঘোষণার মধ্যেই পরিষ্কার। কিন্তু তাঁর কবিতার উপজীব্য পাল্টালেও উপকরণ যা ছিলো, তা-ই রইল। নিজের ব্যাপারে ফয়েজ কী বলেন, এ বিষয়ে আমরা আরও একবার ফয়েজের বিবৃতির কাছে যেতে পারি:
“নিজেকে কবি হিসেবে দেখবার বড় রকমের কোনো ধারণা আমার ছিলো না, কিন্তু আমার ধারণা ছিলো যে, আমি গভীরভাবে প্রেমে পড়েছি। প্রেমে পড়েছিলাম কি-না, সে কথাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। গুরুত্বপূর্ণ ছিলো শুধু এ কথাটাই যে, আমার এই আবেগ চারপাশের সবকিছুর হাব-ভাবকেই বদলে দিয়েছিল।…এই বস্তুরাজির অনুভব থেকে মন আমার সঞ্চারিত হলো চারপাশের মানুষে।”
#storyandarticle
Post a Comment