রুপকুন্ড ট্রেকিং
সুমিত সেন।
ভ্রমণ কাহিনী
: রুপকুন্ড ট্রেকিং
ধারাবাহিক ভাবে লেখার চেষ্টা করছি। প্রতিদিন এক এক জায়গার বর্ণনা ।
রুপকুন্ড (16470 ফুট)
প্রস্তাবনা
চব্বিশ বছরের ও বেশী হয়ে গেল। স্মৃতির প্রতারণা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। তবু চেষ্টা করছি লিখবার। পাতা দেড়েক লিখে রেখে ছিলাম। সেটা আগে লিখে বাকিটা স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে লেখার চেষ্টা করছি
পুনশ্চঃ লেখাটা কেমন হল জানি না, তবে লিখে আমি খুব তৃপ্ত। লেখার সময় বারবার অনুভব করছিলাম আমি যেন এখন সেই পথ ধরে চলেছি।
রুপকুন্ড
: প্রস্তুতি পর্ব
রাত্রি ১০.৩৫। দুর্গাপুর ছেড়ে ট্রেন এগিয়ে চলছে। খাওয়া দাওয়ার পাট মিটতে মিটতে ট্রেন আসানসোল ছাড়ালো।
৫টা ৪৫ নাগাদ নেতাজি কলোনি থেকে রওনা হয়ে ৬টা ৪৫ নাগাদ হাওড়া পৌছে দেখি ‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ী। ‘ ঠিক ৭ঃ২০ তে অমৃতসর মেল ছেড়েছে। একেবারে সঠিক সময়ে। ‘দেশ এগিয়ে চলছে ।'(শুনলাম গাড়ী তে নাকি কোন একজন V. I. P. আছে, হয়তো সেই কারণ ই)।
কিন্তু কপালের গে৺ড়ো খন্ডাবে কে? রাত ১টা ২০ নাগাদ শিব-ভক্ত রা (ব্যোম পার্টি, নিজেদের এই বলেই পরিচয় দেয় তারা) দরজা ধাক্কা দিতে থাকে ঝাঁঝা স্টেশন থামলে। একেবারে দরজা ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম। দরজা খুলতে সবাই নারাজ। হট্টগোল আরো বাড়তে থাকে। আমাদের ঘুমের দফারফা। অবশেষে একজন সিপাহি দরজা খুলে দেয়। জায়গা দখল হতে থাকে, কোনরকমে কুঁকড়ে শুয়ে থাকি।
রাত ভোর হয়। ভোর থেকে সকাল, ট্রেন এগিয়ে চলে ভাল গতিতে, আরা স্টেশন আসতেই ‘ব্যোম পার্টি ‘ প্রায় খালি হয়ে যায়। পরে থাকে কিছু অল্প শিব-ভক্ত, তারা যাবে বালিয়া।
ব্যস, এরপর থেকেই শুরু হয়ে গেল ট্রেন লেটের পালা। রঘুনাথপুর স্টেশন এ গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকলো অনেকক্ষণ, প্রথমে বোঝা যায় না এর কারণ টা। পেপার আসে। প্রথম পাতার হেডলাইন ‘পূর্বা এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত ।’ ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে স্টেশনে। আমরা প্রথমে উসখুস করি, platform এ নেমে ঘোরাঘুরি করি, “ট্রেন কম করে ঘন্টা চারেক এর আগে ছাড়বে না।” শোনার পর স্টেশন এর বাইরে গিয়েও ঘুরে আসি। স্টেশন লাগোয়া টিউবওয়েল এ স্নান করি। জল বেশ ঠান্ডা ছিল, স্নান বেশ আরামদায়ক -ই হল। এর অনেকক্ষণ পরে ট্রেন ছাড়ে, কিন্তু চলে কৈ? দু-একটা স্টেশন যায় আর দাঁড়িয়ে থাকে বহুক্ষণ ধরে। অবশেষে বক্সের আসে, এর কয়েক কিলোমিটার আগেই যেখানে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রেন ধিরে ধিরে বক্সের অতিক্রম করে।
এরপর থেকে ট্রেন বেশ ভালো ভাবেই এগিয়ে চলে। মোঘলসরাই এলে আমরা রাতের খাওয়া সারি। ভোর ৫টা ২০ নাগাদ ট্রেন লখনৌ এসে পৌঁছায়।
আমরা স্টেশন মাস্টার এর ঘরে যাই। কারণ কাঠগুদাম এক্সপ্রেস নির্ধারিত সময়েই ছেড়ে চলে গেছে। স্টেশন মাস্টার আমাদের সহায়তা করেন। বরোলি অবধি যাবার অনুমতি দেন। ট্রেন ৭টায় ছাড়ে, আমরা ২ঃ২০ নাগাদ বরোলি পৌঁছাই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লালকুঁহা যাবার ট্রেন পেয়ে যাই। তাড়াতাড়ি করে মালপত্তর ট্রেনে ওঠানো হয়, ট্রেন একদম ফাঁকা। আমরা ছাড়া বিশেষ আর কেউ ছিল না, তবে যারা ছিল তারা বেশ ভাল ভাবেই তাদের উপস্থিতির কথা জানান দিয়েছিল। পিঙ্কির অসাবধানতায় ওর পাঁচ ব্যাগ থেকে অনেক টাকা চুরি যায়। চোরের দলের দু জনকে আমরা ধরেও ফেলি। তাদের থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় কিন্তু টাকার ব্যাগ টা তারা ততক্ষণে সরিয়ে ফেলে দিতে সক্ষম হয়। তারা স্বীকার করে যে টাকার ব্যাগ টা তৃতীয় জনের কাছে আছে। পুলিশ কেস লেখেন, কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় না।
যাইহোক, লালকুঁহা থেকে একটা ম্যাটাডর ভাড়া করে আমরা হলদুয়ানি পৌঁছলাম। রাতটা সেখানেই একটা হোটেলে (শর্মা হোটেল) কাটালাম। পরদিন আমাদের গন্তব্য গোয়ালদাম। (৬০০০ ফুট)
লালকুঁহা থেকে গোয়ালদাম বেশ অনেক টা পথ। মোটামুটি ১৮০ কিলোমিটার। চামোরিয়া, নৈনিপুল, কতখানি, আড়মোড়া পেরিয়ে গোয়ালদাম। বাসে সময় লাগলো ৬ ঘন্টার ও বেশী। বাস অবশ্য মাঝে বেশ কিছুক্ষণ বিরতি দিয়েছিল।
গোয়ালদাম এর হোটেল টা বেশ ভালো। ‘হোটেল ত্রিশূল। ‘ আমাদের গাইড গঙ্গা সিং আমাদের সঙ্গে দেখা করলেন, রাতের খাবার টা ও গঙ্গা সিং ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, রুটি আর কচিপাঁঠার মাংস।
কাল থেকে ট্রেকিং শুরু।
আজ (২৩/৮/৯৬) সকালবেলা আমরা গোয়ালদাম থেকে দেবলের উদ্দ্যেশ্য রওনা দিলাম। এখান থেকেই আমরা ট্রেকিং শুরু করি, যদিও আমাদের ল্যগেজ এবং রেশন একটা গাড়ীতে চলে গিয়েছিল। আমরা এদিন খালি পিঠে এবং খালি হাতে হেঁটে ছিলাম। (এখানে বলে রাখা ভালো যে লোহা জং পাস পর্যন্ত গাড়ী করে যাওয়া যায়।)
বনের মধ্যে দিয়ে খুব শর্টকাট একটা রাস্তা দিয়ে গাইড আমাদের নিয়ে দেবলের উদ্দ্যেশ্য রওনা দিয়েছিলেন। অপূর্ব সুন্দর মনোরম দৃশ্য। বন রাজির অপূর্ব শোভা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নেসপাতি গাছে উঠে নেসপাতি পারছে, আমাদের দেখতে পেয়ে আমাদের কাছে লজেন্স চাইল, আমরা প্রচুর পরিমাণে লজেন্স নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের নিজেদের জন্য এবং পথে বিলাবো বলে। আমরা তাদের লজেন্স দিলাম আর আমাদের প্রাপ্তি ঘটল নেসপাতি আর তাদের উজ্জ্বল চোখ -মুখ।
“মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে
আমি মানব কী লাগি একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে।
তুমি আছ বিশ্বেশ্বর সুরপতি অসীম রহস্যে
নীরবে একাকী তব আলয়ে।
আমি চাহি তোমা -পানে-
তুমি মোরে নিয়ত হেরিছ, নিমেষবিহীন নত নয়নে। ”
কবিগুরুর এই গান টা ই যেতে যেতে মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। গুনগুন করে গাইছিলাম ও। পথে বৃষ্টি পেয়েছি তাই বর্ষাতি ও পরতে হয়েছে। সোয়া এগারোটা – সাড়ে এগারোটা নাগাদ দেবলের ট্রেকারস (বানান টা এর চেয়ে ভালো ভাবে লেখা যাচ্ছে না) হাটে।
গ্রুপের অন্য সকল সদস্য আমার বেশ কিছু টা আগেই গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছিল। আমি পৌঁছানো মাত্রই হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দিল। শরীর মন দু- ই জুড়িয়ে গেল। হাসি ঠাট্টা লেখ পুলিং করে দুপুর টা বেশ ভালো ভাবেই কেটে গেলো। বিকেলে আমরা সবাই মিলে আশপাশ টা ঘুরলাম। চরাচর বৃস্তিত নৈসর্গিক সৌন্দর্য। উপর দিকে মাথা তুলে তাকালেই আদিগন্ত মৌন পাহাড়। এখানে সন্ধ্যা নামে বেশ দেরীতে। সন্ধ্যার পর আর বিশেষ কিছু করার থাকে না। একটা ফায়ার প্লাস যদিও ছিল আমরা তাতে আগুন পোহাই নি।
রাত্রি তে (কলকাতা হলে সন্ধ্যা) একবার বাইরে বের হতে হলো খাবার জল আনার জন্য। বেশ অনেকটা পথ। কিলোমিটার খানেকের বেশী বৈ তো কম নয়। রাত্রি তে শুনশান নির্জন পাহাড়ী রাস্তায় হাঁটার অভিজ্ঞতা বেশ উপভোগ করলাম। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরলাম। পরদিনের গন্তব্য লোহা জং পাস। বেশ অনেকটা পথ।
গন্তব্য লোহা জং পাস (২৪/৮/৯৬), উচ্চতা ৮০০০ ফুট এর কাছাকাছি। লোহা জং পাস পর্যন্ত অনেকেই গাড়ীতে ই যান, আমরা চলেছি ট্রেকিং করে। দেবল থেকে এর উচ্চতা ৩৫০০ ফুট মত, রাস্তা কমবেশী ২২ কিলোমিটার। সকাল ৮টা নাগাদ হালকা নরম রোদ আর রুট স্যাক পিঠে নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পরেছিলাম। গাড়ীতে না এসে হেঁটে আসছি বলে বেশ ভালোই লাগছিল। বেশ উপভোগ্য ট্রেকিং। ২২ কিলোমিটার যাত্রায় মাত্র ৩৫০০ ফুট চড়াই। পথে অসংখ্য ঝর্ণা, সুবিশাল বৃক্ষরাজি এবং মনোরম আবহাওয়া – মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। আমি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নই , সামান্য একজন পর্বত প্রেমী- আমার পক্ষে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনা অসম্ভব, কেবলমাত্র প্রকৃতির রং-রুপ-রস উপভোগ করাই আমার পক্ষে সম্ভব। যাইহোক প্রকৃতির অপরূপ রুপ উপভোগ করতে করতে বিকেল ৫টা নাগাদ লোহা জং পাস এসে পৌঁছলাম। অনেকেই আমার অনেক আগে এসে পৌঁছে গিয়েছিল, আমি প্রকৃতিকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে করতে আস্তে আস্তে হাঁট ছিলাম।
আমার ও বেশ কিছুক্ষণ পরে বাপীদা আর তাপস এসে পৌঁছল, ওরা লোহা জং পাস পৌঁছানোর একটু আগে একটা ঝর্ণার কাছে অনেকক্ষণ বসেছিল।
ফ্রেশ হয়ে চা-স্ন্যকস খেয়ে ট্রেকারস হাটের লনে বসে যাই-যাই বিকেল ও সন্ধ্যা উপভোগ করতে লাগলাম। হিম পরা শুরু হলে পর আমরা ট্রেকারস হাটের ভিতরে চলে এলাম। রাতে বিশেষ কিছু করার থাকে না, খেয়ে ঘুমিয়ে পরা ছাড়া। পরের দিনের গন্তব্য দিদিনা।
গন্তব্য দিদিনা (২৫/৮/৯৬)। দূরত্ব সাড়ে নয় কিলোমিটার, উচ্চতা ৮৮০০ ফুট, কুলিং গ্রাম হয়ে। কিছুদূর এগিয়ে নদীর একটানা ক্ষীণ গর্জন শোনা যাচ্ছে। পথটা নিম্নমুখী। আমরা মনের আনন্দে হেঁটে চলেছি, একটা করে ঝরণা, নদীর সেতু অতিক্রম করছি মাঝে মাঝে।
অরণ্যভূমি থেকে বেরিয়ে এক অপুর্ব – সুন্দর ছোট্ট চারণভূমিতে হাজির হলাম। ছাগল, ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ এর জন্য সবাই ঘাসের গালিচায় গা এলিয়ে দিলাম। আমাদের সঙ্গে থাকা একজন কুলি ছাগলের দুধ জোগাড় করে আনলো। আমরা তা ভালোভাবেই আস্বাদন করলাম। চরৈবেতি, চরৈবেতি – আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। ছোটো একটা গ্রাম পেরিয়ে এগিয়ে চললাম। নীল গঙ্গার গর্জন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। অবশেষে দেখা হল নীল গঙ্গার সাথে।
স্থানীয় লোকজন জায়গাটাকে বলে রণবাগাদ। আমাদের গাইড সেতুটির উপর কয়েক টা গাছের ডাল পুঁতে দিল দেহের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য। মন ভরে দেখলাম নীল গঙ্গার পাগলপাড়া গতিকে। অরণ্যর বুক চিরে সামনের পাহাড়ের গা বেয়ে একটা লম্বা ঝরণা নেমে আসছে। এখানেও আমরা বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। অনেক ছবি তোলা হল। সেতু পেরিয়ে কিছুটা যেতেই শুরু হল চড়াই। আমার হাঁটার গতি আবারো স্লথ হল। অবশ্য আজ রাস্তা অনেক কম তাই চিন্তার বিশেষ কারণ নেই।
অবশেষে চড়াই শেষ হল, বাড়ী ঘর আর মানুষ জনের দেখা মিলল।
দিদিনা গ্রামে পৌঁছলাম সাড়ে তিন টে নাগাদ, থাকার বন্দোবস্ত স্কুল বাড়ীর ঘর। ধু ধু চরাচর। স্কুল প্রাঙ্গনে বসে আমরা রৌদ্দ্যস্নান উপভোগ করতে লাগলাম। গ্রামের কচিকাঁচা কয়েকটি ছেলে মেয়ে আমাদের কাছে এল, আমরা তাদের লজেন্স দিলাম। দিদিনা আসার পথেও ছোট ছেলে মেয়েদের দেখা পেলেই আমরা লজেন্স বিলি করেছি, বিনিময়ে আমরা পেয়েছি তাদের হাসিমাখা উজ্জ্বল মুখ। বিকাল ও সন্ধ্যাটা আমরা স্কুল প্রাঙ্গনে বসেই কাটিয়ে দিলাম। গতানুগতিক রাত্রি যাপন। পরদিন সকাল সকাল উঠতে হবে কারণ সকালবেলা স্কুলঘর ছেড়ে দিতে হবে স্কুল শুরুর আগে। তাই তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পরলাম । কালকের গন্তব্য বৈদিনী বুগিয়াল।



Post a Comment