উপন্যাস – হৃদয়কুসুম – সুদীপ ঘোষাল
বর্ধমান জেলার পূর্ব অংশে কেতুগ্রাম থানা। হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত মেলায় গড়ে উঠেছে এই জীবন মাঠ।
এই থানার অন্তর্গত অনেকগুলি গ্রামের এই ইতিহাস। এখানে সতীপীঠ আছে দুটি। একটি নিরোলের কাছে অট্টহাস আর দ্বিতীয়টি কেতুগ্রামের বহুলা মায়ের মন্দির। কতকগুলি বর্ধিষ্ণু গ্রাম এখানে আছে। নিরোল, পাঁচুন্দি। গোমাই, কেতুগ্রাম, পুরুলিয়া, কোপা, কোমডাঙ্গা, ভুলকুড়ি, চরখী, শিবলুন, বেলুন, অম্বলগ্রাম প্রভৃতি আরও অনেক গ্রাম নিয়ে এই বিশাল এলাকা।
কেতুগ্রামের মসজিদের আজানের সুর ছড়িয়ে পড়ে এলাকার গ্রামে গ্রামে। সকলের মঙ্গলের স্বার্থে এই ব্যবস্থা। গঙ্গাটিকুরি গ্রামে আর পুরুলিয়া গ্রামে এখনও গেলে অনেক পুরোনো রাজবাড়ি দেখা যাবে। প্রতিটি গ্রামের আনাচে কানাচে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস ফিস ফাস করে কথা বলে। একটু অনুসন্ধানী মন নিয়ে এইসব অঞ্চলে এলে ইতিহাসবিদের মনস্কামনা পূর্ণ হবে বলে মনে হয়। এখানে আঞ্চলিক নদী আছে যার নাম ঈশানী। আর এক প্রিয় নদ আছে অজয়। এই অজয়ের তীরে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বাড়ি ছিল। নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে অনেক গ্রাম অনেক বাড়ি। আর এতদ্ অঞ্চলের কয়েকজন মানুষের জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কাহিনীর শরীরবাঁশি।
বিশুকে দলের ক্যাপটেন বলে মেনে নিয়েছি আমরা । ক্যাপটেন তো এমনি এমনি হয় না। বিশুর চরিত্রের দৃঢ়তা তাকে নেতা বানিয়েছে। স্কুল লাইফে ফুটবল খেলে ও কত পুরষ্কার এনে দিয়েছে তার হিসেব নেই। ছোট থেকেই বিশু সাহসী আর একরোখা ছেলে। বিশুর গুরুদেব তার মামাত ভাই দিলীপ। বিশুকে লাঠিখেলা, সাঁতার, ফুটবল, কুস্তি সমস্ত বিষয়ে পরামর্শ দিত ভাল। কার কাছে কোথায় গেলে শেখা যাবে, নিজেকে ুউন্নত করা যাবে এ সমস্ত বিষয়ে দিলীপ সুপরামর্শ দিত। আমি জানতাম না কি করে বিশু এতবড় একটা মন পেল। তার মনে সবসময় ভারতবর্ষীয় এক সেবাবোধ কাজ করত। প্রাচীন মুনিঋষি থেকে শুরু করে ত্যাগের দেশ আমাদের।
ভোগবিলাসের জীবন বিশু পছন্দ করে না। স্কুল লাইফে সেই ছোটবেলার স্মৃতি বিশু ভুলতে পারে না। তখন কত বন্ধু ছিল। কালের প্রবাহে কে কোথায় ছিটকে পড়েছে কে জানে? ছোটবলায় স্কুল লাইফে রমেন, বিরাজুল, বিশু আর আমি, যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ,দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো। একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো।
ঠিক যেনো রাধার পোড়া বাঁশির ডাক। চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়। আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশুবলতো, দাড়া কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি । ভেজে খাওয়া যাবে। বিরাজুল বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম প্রিয় ছিল। তার মধ্যেও জাতপাত নিয়ে কোন গোঁড়ামি ছিল না। বিভিন্নতার মধ্যেও ঐক্য ছিল হৃদয়জুড়ে তার।
মাছ বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে বিশু। একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয়একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়।
গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিরাজুল আর হুুজুর বিশুর নেতৃত্বে। আমরা তার কথায় হয়ে যেতাম হুজুরেে হাজির। আরও অনেক বন্ধু ছিল আমাদের। তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু।
সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে।
একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।
পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না। আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে।
পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি? বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়।বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন সে পেল কোথা থেকে?
স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেড মাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে। ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশি বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলেুু উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।
বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের। তার অভয় বাণী ভরসা করে আমরা মাল পত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে। ক্যাপটেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো। জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো, যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো, ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে।
এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো। ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পরলে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো। কুসংস্কার বিশুর মন আচ্ছন্ন করতে পারে নি কোনদিন।
হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা,গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে।
কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানেআর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌকা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো।
আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে। গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম,তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সব্জী।
, খলসে, ওআরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো।বেলে, তে চোখো,চ্যাঙ,ছিঙুরি,গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনরকবার তআল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে।পাঁকাল,গুঁতে,কৈ,মাগুর,ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে। আর এসব মাছ জমিতে কীটনাশক প্রয়োগে আর দেখা যায় না। বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো।
টানা জাল,পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী।। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরীবউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণ যুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বিশুর কথা ভোলা যায় না। স্কুলের বন্ধু হলেও হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরদিনের মতো ঠাঁই করে নিয়েছে সে। জোর করে কারও হ।দয় দখল করা য়ায় না। তার জন্য নীল আকাশের মতো হৃদয়ের প্রসারতা চাই। বললো,অনুপম। অনুপম তার দলবল নিয়ে স্কুল থেকে ছাত্রদের ও ছাত্রীদের পুরী বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ছিলো। অনুপম জনপ্রিয় ভালো গৃহশিক্ষক। একটা ঘর ভাড়া করেছিলো শহরে। অনুপমের বয়স বত্রিশ বছর। ছাত্রদের বলতো,স্যার বলবি না। ওসব ভালো লাগে না। দাদা বলবি বা নাম ধরেও ডাকতে পারিস।
অন্তরের ভালো লাগা বা শ্র দ্ধা থাকলেই অনেক। যদি তোদের মধ্যে একটা হৃদয়ে জায়গা হয় আমার সেটাই যথেষ্ট। গুঁতিয়ে হরিনাম হয় না রে। সামনে ভক্তি আর পেছনে গালাগালি। পছন্দ করি না কাকা। ছাত্রদের মধ্যে বিশু খুব ডানপিটে ছেলে। অনুপম দাদা বাথরুমে গেলেই তার আলনায় ঝোলানো জামার পকেট থেকে সিগারেট বের করে খেতো। অনুপম জানতো। কিছু বলতো না। পড়ানোর সময় বলতো,সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়, ধর্ষণ করলে ফাঁসি হয়। তবু কিছু মানুষ এগুলো ভুলে যায়। সাবধান। শুধু পড়াশোনা নয়। মানুষ হতে হবে। বিশু পুরী বেড়ানোর দলে ক্যাপটেন। অনুপম ছেলে মেয়েদের দেখাশোনার দায়ীত্ব বিশুর ওপর দিয়েছে। তাদের জন্য জান দিতেও পিছুপা হবে না বিশু,একথা সবাই জানে।
ট্রেনের সিট খুঁজে সবাই উঠে বসলো জগন্নাথ এক্স্প্রেস। ঠিক পরের দিন দশটার সময় পৌঁছে গেলো পুরী হোটেলে। সেখানে একটা সুন্দর ফুলের বাগানে তারা অনেক ছবি তুললো। রবি একটা ফুল তুলেছে। গোলাপ। হোটেলের মালকিন ডেকে পাঠালেন স্যারকে। বললেন,হাজার টাকা ফাইন দিতে হবে। যারা ফুলের মর্যাদা দিতে জানে না, গুণীজনের মান দিতে জানে না, তাদের শাস্তি হওয়ায় উচিত। স্যার অগতির গতি বিশুকে ডেকে পাঠালেন। বিশু এসেই ম্যাডামকে বললো,ম্যাডাম আমাদের দলে একটি ছেলে ভুল করেছে। ভুল তো মানুষের হয়। কিন্তু আপনি তার থেকে বড়ো ভুল করতে চলেছেন।
—— কি রকম ভুল?
বিশু ও আমরা তখন, বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার বন্ধু ছিল অনেক। তার মধ্যে সর্দার ছিলো বিশু। এখন যার কথা বলবো তার নাম অলক।বাড়ি তার কোমডাঙ্গা। স্কুলে যত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো তার প্রধান দায়ীত্বে থাকত আমাদের দলের প্রধান বিশু। আর কান টানলেই মাথা আসে। হাত বাড়ালেই বন্ধুদল হাজির। বিশু মানেই আমরা সবাই। আমাদের বন্ধুরা এই পরোপকারী নির্ভিক নেতার ভক্ত।স্কুলে ঠিক হলো এবার রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠান হবে সন্ধ্যাবেলায়। নাটক,আবৃত্তি,গান সব হবে।
—-স্যর,আমার গ্রামের ডোম পাড়ার তিন বুড়ির কাছে আমি রাতে থাকি। তাদের সুবিধার জন্য রাতে আমি কোথাও থাকি না।
মাষ্টারমশাই বিশুকে চেনেন, জানেন।চোখের জল আড়াল করে বললেন,বেশ তাই হবে।
তারপর চলে এলো ২৫শে বৈশাখ। দিনের বেলা বলা হলো সকলের বাড়িতে। দুপুরে ঘুমিয়ে নিলাম সবাই।তারপর সকলকে সঙ্গে করে বিশু চললো স্কুলে।কোমডাঙ্গার অলক চলে এলো আমাদের সঙ্গে। আলপথে হেঁটে চলে এলাম কাঙরা গাবা। সেখানে একটা কাঁদর।তার পাশে একটা ঝুড়ি নামা বটগাছ।দিনের বেলাতেই জায়গাটা অন্ধকার। বিশু বললো আমি রাতে ফিরবো। তোরা হষ্টেলে থেকে যেতে পারিস। আমি বললাম,না আমরা সবাই বাড়ি ফিরবো। বিশু বললো,তাই হবে।
তারপর কাঁদর পেরিয়ে চলে এলাম হেঁটে স্কুলে। তারপর কাজ শুরু হলো। বিশু ঘোষকের ভূমিকায়।বড় সুন্দর অনুষ্ঠান পরিচালনা করে বিশু। প্রথমে লীলা উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করলো,আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে”। তার পর সভাপতি নির্বাচন।প্রদীপ প্রজ্জ্বলন,প্রধান অতিথি বরণ হলো।সকলে কবিগুরুর গলায় মালা দিলেন। তাঁর সম্বন্ধে দু চার কথা বললেন।
আমি বললাম,সভাপতি নির্বাচন আগে করলে হত না। বিশু বললো,জানি সব জানি। তবে কি জানিস,আমার প্রিয় কবির জন্মদিনে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করার মত তাঁকে আগে বরণ করলাম। বাংলার মাষ্টারমশাই বললেন,তুই বিশু যাই করিস আমাদের ভালো লাগে। চালিয়ে যা।তারপর নাটক হতে হতে রাত দশটা বেজে গেলো।বিশু তাড়াতাড়ি স্যারের হাতে দায়ীত্ব দিয়ে আমাদের কাছে চলে এলো। হষ্টেলে খাওয়া হলো। তারপর বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্য।
বিশু ছুটে গিয়ে অলককে ধরতে গেলো আর সঙ্গে সঙ্গেই এক বিকট হাসি অলকের মুখে। যে অলক সাত চরে রা কাড়ে না সেই অলক ভূতুড়ে হাসি হাসতে হাসতে কাঁদরের জলের উপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি বললাম,বিশু অলক কই? বিশু বললো,এই কাঙরা গাবায় ভূত আছে। এসব তার কাসাজি। শুনে রতন ও আমি বু বু করতে লাগলাম ভয়ে। বিশু বললো,চল ওপাড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই। আমরা কাঁপতে কাঁপতে জল পার হয়ে ছুটে চলে গেলাম অনেক দূরে। বিশু বললো,হ্যারিকেন দুটো ফেলে এসেছি। চল নিয়ে আসি। আমরা বললাম,বিশু তোর পায়ে পড়ি বাড়ি চল। হ্যারিকেন চুলোয় যাক।
তারপর বিশু ও আমরা অলকের বাড়ি গেলাম। বাড়ি যেতেই ওর বাবা বাইরে এলেন। বিশু বললো,কাকু অলক ফিরেছে। কাকু বললেন,না তো।সে কোথায় গেলো। বিশু সব ঘটনা খুলে বললো।কাকু বললেন,চলো আমরা সবাই থানায় যাই। সেখানে একটা খবর দেওয়া দরকার। আমি জানি কাঙরা গাবায় তেনারা থাকেন। রাতে তোমাদের যাওয়া ঠিক হয় নাই গো।
আমরা সবাই রাত জেগে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। অলকের বাবা লিকার চা করে খাওয়ালেন। ধীরে ধীরে পূব আকাশে সূর্য উঠলো।সব ভয় সরে গিয়ে আলো ফুটে উঠলো।
সে বললো,আমরা সবাই যখন কাঙরা গাবায় কাঁদর পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই আমাকে খনা গলায় নিশি ভূতটা বললো,কি রে তোর বাড়ি গিয়ে ডাকলাম। সাড়া পেলুম না। তাই গন্ধ পেয়ে এখানে এলাম। চল আমার সঙ্গে তোকে হাওড়া ব্রীজ দেখিয়ে আনি। আমি বললাম,এই রাতে বন্ধুদের ছেড়ে আমি হাওড়া যাবো না। নিশিটা বললো,যা বলবো শুনবি।তা না হলে উঁচু থেকে ফেলে দেবো।আমি আর ভয়ে কথা বলিনি। নিশি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো হাওড়া ব্রীজে। আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। তারপর যখন নিশিটা আমাকে নিচে নামালো তখন জ্ঞান এলো। নিশি বললো,কেমন লাগছে। কি খাবি বল। তারপর আবার বললো,গঙ্গার জলে সাঁতা কাটবি নাকি?
বন্ধুর বলতো ওর বয়স বেড়েছে,মনটা কিন্তু শিশুর মতো রয়ে গেছে। ছোটোবেলায় কেউটে সাপ ধরা,গঙ্গা সাঁতার কেটে পেরোনো,গ্রামে গিয়ে ভূত ধরা সব মনে পরে বন্ধুদের। বাউড়ি বৌকে নিজের খাবার দিয়ে দিতো বিশু। সেই বিশু আজ নিজে একমুঠো খাওয়ার জন্য ছাত্র পড়ায়।বিয়ে করেছে সে।একটা কন্যা সন্তান হয়েছে।তারা গ্রামের বাড়িতে বড়দার কাছে থাকে।
বড়দাকে মাসে পাঁচশো টাকা দিয়ে আসে।বিশু বাসা ভাড়া করে থাকে শহরে।একটা বোতল আর বিছানা তার সম্পত্তি।খাওয়াটা বেড়ার সস্তার হোটেলে সেরে নেয়। একটা ট্রেনের যাত্রীর মত তার জীবন।তবু তার মনে আনন্দের অভাব ছিলো না। আনন্দের ফেরিওয়ালা সে।কারও কোনো অসুবিধা হলেই তার ডাক পড়তো আগে।এবার বিশু চললো গঙ্গার ধারে নীলুদার আশ্রমে। নীলুদা বললেন,ওই তো সামান্য রোজগার। নিজেই সব খেয়ে নিলে পরিবারকে খাওয়াবি কি?
বিশু বললো,দাদা,তোমার ঘাড়ে বোঝা হয়ে যাবো আমি।তুমি সাধক মানুষ।তোমার অসুবিধা হবে না তো? নীলুদা বললেন,আমি ওসব বুঝি না।যদি আমি খেতে পাই। তোরও একমুঠো হবে।যা ওপরের ঘরে যা। রাত হোলো।বিশুর ঘুম আসে না,গঙ্গার ধারে ওপাড়ে মরা মানুষ পুড়ছে।শবদেহের পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে।হঠাৎ বিশু শুনতে পেলো,কিঁ রেঁ,ভয় পাঁচ্ছিস? বিশু তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলো।নীলুদা বললেন,কি রে ঘুম আসছে না? এই নে খা। তারপর গিয়ে শুয়ে পড়।
মোরোব্বা খেয়ে ঠাকুরকে প্রণাম জানিয়ে বিশু শুয়ে পড়লো।ঘুম ভাঙ্গলো একদম সকালে। সকালে হরিনাম শুনলো।মন্দিরের সিঁড়িতে জল দিয়ে ধুয়ে ফুল রাখলো।তারপর চলে গেলো ছাত্র পড়াতে।সেখানে চা বিস্কুট খেলো পরপর বারোটা অবধি ছাত্র পড়াতো।যেসব ছাত্ররা স্কুলে যেতো না,তারা ফোন করে ডেকে নিতো বিশু মাষ্টারকে। ছাত্রদের সঙ্গ তার ভালো লাগতো।
তবে দু একটি বাড়িতে ছাত্রের অভিভাবক বসে থাকতেন। পড়ানো পরখ করতেন। তারওপরই মাষ্টারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করতো।একবার এক বড়লোকের বাড়িতে মালকিনের ধমকে সে অপমানিত হয়ে পড়ানো ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো।কারণ,ছাত্র প্রথম স্থান অধিকার করতে পারে নি।বিশু বলেছিলো,এবার পারেনি,আসছে বার পারবে নিশ্চয়।মহিলা বলেছিলেন,সরকারি চাকরি পাবে না,সেকেন্ড হলে। ফার্ষ্ট হতে হবে। আমি অন্য মাষ্টার দেখবো।বিশু ছেড়ে দিয়েছিলো পড়ানোটা।
তারপর এলো সুখবর।নীলুদা বললেন,তুই মায়ের সেবা করে যা। মা তোকে দেখবেন।সত্যি,মা দেখেছিলেন।জীবনের কঠিন সময়ে মা সত্যিই একটা পার্শ্বশিক্ষকের চাকরী পাইয়ে দিয়েছিলেন। বিশুর ভাই খবর পাঠালো,দাদা গ্রামের স্কুলে দু হাজার টাকায় পার্শ্ব শিক্ষক নেবে। তুমি আ্যপ্লাই করো।বিশু পেয়ে গিয়েছিলো চাকরীটা।টিউশানির থেকে ভালো।মাইনে কম হলেও নিশ্চয়তা আছে।বিশু বন্ধুদের বললো।বন্ধুরা বললো,তুই সকলকে সাহায্য করিস। তোর কোনোদিন অভাব হবে না।
মানুষের আশীর্বাদ তোর সঙ্গে আছে। তারপর নীলুদার আশীর্বাদে বিশুর নিজস্ব বাড়ি হোলো।আর বাসা বাড়ি নয়।নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো মেয়ে আর বৌকে। চারদিকে বাঁশের বেড়া। কাছেই একটা গরীব পাড়া আর একটা পুকুর।সাপের রাজত্ব।সেখানে ঘর বাঁধলো বিশু। একবার রাতে বিরাট এক গোখরো ঢুকে পড়লো বিশুর ঘরে।ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে সাপটা।মশারির ভেতরে বৌ আর ঘুমন্ত কন্যা। বিশু এক হাতে লাঠি নিয়ে ফণা চেপে ধরলো সাপটার। আর অন্য হাতে সাপের লেজ ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে এলো বাইরে।
তারপর বনের ভিতর ছেড়ে দিলো সাপটা। রাত হলেই তার উঠোন দিয়ে চলাচল করতো নানারকম সাপ।ডোমনা চিতি,শাঁখামুটি,চন্দ্রবোড়া,গোখরো কিছুই বাদ ছিলো না। সকলে বলতো মাঝমাঠে বাড়ি করলে ওইরকমই হয়। বিশু কি করে বোঝাবে,সে প্রকৃতির সন্তান। এই বন,জঙ্গল,সাপ তার বড় প্রিয়। সে সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকতে চায় না। কিন্তু মানুষ, সবাইতো আর সমান হয় না। প্রতিবেশিদের একজন তাকে শিক্ষা দিতে চায়,গাড়ি,বাড়ি আর নারী, ভেবেচিন্তে নিতে হয়। বড় নিষ্ঠুর কিছু মানুষ।
গাড়ি,বাড়ি জড় পদার্থের সঙ্গে মায়ের তুলনা করে।বিড়বিড় করে সে। মনে ভাবে,আমি বিশু, আমার সামনে যা তা কথা বলে পার পেয়ে যায় এখন মানুষ।কিন্তু জানে না,এই বিশু ওদের শায়েস্তা করতে পারে এক মিনিটে।কিন্তু সময় বড় বিচারক।সে আজ বিশুকে কঠিন লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়েছে। জীবনে টিকে থাকার লড়াই। এই যুদ্ধে ক্রোধের জায়গা নেই। ক্রোধকে জয় করার লড়াইয়ে জিততে হবে। তবেই হবে তার জয়।
পায়েস খেতাম শেষ পাতে। রকমারি খাবারের সুগন্ধে মৌ মৌ করতো মায়ের হেঁসেল ঘর। পালো, বলে একরকমের খাবার মা বানাতেন যত্ন করে। সকালে উঠেই পালো খেয়ে ভুরিভোজ সারতাম। তারপর পিঠে রোদ লাগিয়ে সরব পড়া। বোঝার থেকে চিৎকার হতো বেশি। আনন্দ পেতাম সরব পড়ার প্রতিযোগিতায়। পাশের বাড়ির বন্ধুদের সরব পাঠের আওয়াজ পেলেই,ততোধিক জোরে শুরু করতাম পাঠ। স্কুলে গিয়ে তার আলোচনা হতো ক্লাসে। আরও জোরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো মাসের পর মাস। কোনো দুঃখ,কষ্ট আমাদের মনে রেখাপাত করতে পারতো না। জীবনের আনন্দ ছড়ানো থাকতো ধুলো জোড়া পথে। এই ধুলো,মাটির সুগন্ধ আমাদের ভারতবর্ষের প্রাণ।
ধনেপ্রাণে মারার রোগ।পৃথিবীটা অলকেশের কাছে বড় শূণ্য হয়ে ঘুরতে লাগলো।জীবন অর্থহীন মনে হোলো।মাসে দুলক্ষ টাকা খরচ। তাহলে কিছুদিন মাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। এখন কোন দিকে যাবে অলকেশ।সব আয় এক করেও তো মাসে দুলক্ষ হবে না। অলকেশের মা বললেন, আমাকে বাড়ি নিয়ে চ।আমার কিছুই হয় নি।মনের জোরের কাছে ক্যান্সার হেরে গেলো…
বাসটা জলে পরা মাত্র পাড়ে বাঁধা নৌকো খুলে মাঝিকে পাঠালো মাঝ বিলে। আর নিজে ডুব সাঁতারে প্রায় তিরিশ ফুট নিচে নেমে তুলে আনলো প্রাণ। আবার ডুব দিলো। এইভাবে প্রায় দশজনের প্রাণ বাঁচালো বিশু।নৌকায় তুলে, নিয়ে এলো বিলের পাড়ে। তাদের মধ্যে একজন মারা গেলো। আর বাকি নয়জনকে পাঠিয়ে দিলো হাসপাতালে।
জনতা রেগে আগুন ধরিয়ে দিলো আর একটি বাসে।
বিশু বললো,এসো আমরা সবাই প্রাণ বাঁচাই। আগুন ধরিয়ে কোনো সুরাহা হবে না। তার কথায় কাজ হলো। সবাই একত্রে বাঁচালো আরও প্রাণ। আর বাকি মানুষগুলো মরে ভাসতে থকলো চোখের সামনে,মরা মাছের মতো। বিশুর চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল পরলো শান্ত বিলের জলে। জলের ভাষা পড়তে জানে বিশু। সে শুনতে পেলো,একটা পাগল বলছে, আমার তো অপরাধ নেই।
শান্ত বুকে আছাড় মেরে মানুষ মারার দল টাকার লোভে আইন মানে না।রাস্তায় চলার নিয়ম জানে না। তবু তোমাকে আমি শ্রদ্ধা জানাই বিশু।তুমি প্রকৃতির সন্তান। এই পাগলটা বিশুকে খুব ভালোবাসতো।সে তাকে বলতো,তুই আমার ভগবান বিশু…বিশু বলতো, ভগবান নই, আমি মানুষ।মানুষের জন্য তাই আমার হৃদয় কাঁদে।
রমেন খুব ভিতু। সে বিশুকে বলত কি করে তুই এত সাহসী হলি। বিশু পড়াশুনায় খুব ভালো না হলেও বিশ্লেষণি ক্ষমতা আছে নিজস্ব।
বিশু বলে, একজন মানুষ তার বসকে দারুন ভয় পায়। একটা বিশেষ কারণে ছুটি দরকার হলেও সে বসকে বলার সাহস করতে পারছে না। বলতে না পারার কারণে সেই বিশেষ দিনটা এসে আবার চলেও যায়। কিন্তু তার আর ছুটি চাওয়া হয় না। কিন্তু তার আসলে ছুটি পাওনা আছে – চাইলেই সে ছুটি পেত। – এটা তো খুব ছোট উদাহরণ দিলাম। নিজের উপরের লেভেলের মানুষের কাছে সঠিক সময়ে সঠিক কথাটি বলতে না পারার কারণে কত মানুষ যে ক্যারিয়ারে পিছিয়ে পড়ছে – তার কোনও ঠিক নেই।ভেবে দেখতো, এমন কত কিছু একজন মানুষের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হত – যদি সে করে শুধু চেষ্টা করতো।
আমি বললাম, এমন অনেক প্রতিভাবান মানুষ আছে, যারা তাদের প্রতিভা কাজে লাগিয়ে অনেক বড় ব্যবসায়ী হতে পারত – কিন্তু ‘ব্যবসায় ব্যর্থ হলে কি হবে’ – এই নিয়ে ভয় পেয়ে তারা চেষ্টাই করেনি।আবার ধর না থাকা, অপরিচিত জায়গায় গিয়ে নার্ভাস হয়ে পড়া, বিশেষ বিশেষ মানুষের সামনে নার্ভাস হয়ে যাওয়া, বিশেষ জন্তু বা জিনিসের সামনে পড়লে ভয় পাওয়া – ইত্যাদি ভয়ও খুব কমন। আর তারচেয়ে বড় কথা – এই ভয়গুলো জয় করা সম্ভব এবং তা করতে পারলে একজন মানুষের জীবন অনেক বেশি স
বিশু বলল,সত্যি কথা বলতে, নিরাপদ থাকার জন্য ভয়ের প্রয়োজন আছে। কিছু ভয় মানুষকে খারাপ কাজ এবং বিপদ থেকে দূরে রাখে। আইনে যদি গুরুতর অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান না থাকতো, অথবা অন্যায় করার জন্য ধর্মে পরকালে শাস্তির কথা বলা না হত – তাহলে অপরাধের মাত্রা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো – তা চিন্তাও করা যায় না। একজন মানুষের যদি বাঘের ভয় না থাকে, তবে সে চিড়িয়াখানায় বাঘ দেখতে গিয়ে বাঘের খাঁচায় হাত ঢোকাতে ভয় পাবে না – ফলে তার হাত, এমনকি জীবনও চলে যেতে পারে।তাই বুঝতে হবে – কোন কোন ভয়গুলো আপনার উপকার করছে, এবং কোন ভয়গুলো আপনার ক্ষতি করছে – বা আপনার উন্নতিকে থামিয়ে রাখছে।
এটা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হল ঠান্ডা মাথায় এক জায়গায় বসে নিজের ভয়গুলোকে লিস্ট করা। বিজ্ঞানের ভাষায় লেখালেখিকে বলা হয় “সাইকো নিউরো মোটর এ্যাক্টিভিটি”। সাধারণ ভাবনার চেয়ে লেখার সময়ে মানুষের মনযোগ অনেক বেশি থাকে, এবং যে কোনও বিষয়ের অনেক খুঁটিনাটি ব্যাপার মানুষের চোখে পড়ে।এই ব্যাপারটিকে তোর সাহস বৃদ্ধির একটি ধাপ হিসেবে ব্যবহার করতে পারিস। ঠান্ডা মাথায় একা বসে একটি কাগজে তোর ভয়গুলো লেখ। ছোট বড় সব ভয় লিখে ফেল। যে যে জিনিসকে একটু হলেও ভয় পাস – মনে আসা মাত্র লিখে ফেল। সময় নিয়ে লিখ – তাড়াহুড়া করবি না।
আমি বললাম, এটা বোঝার জন্য কোন ভয়ে কি রিএ্যাকশন বা প্রতিক্রিয়া হয় – সেটাও লিখতে পারিস। তাহলেই বুঝতে পারবি ভয়টি তোর জন্য ভালো না খারাপ।
কেউ যদি সাপ ভয় পান, তবে সেটা ভালো। সাপের কামড় খাওয়া মোটেই ভালো কিছু নয়। কিন্তু সাপ দেখলে যদি আপনি মাথা ঘুরে পড়ে যান – তবে এই রিএ্যাকশনটি তার জন্য খারাপ।আবার মানুষের সামনে কথা বলার সাহস না থাকাটা কোনও দিক দিয়েই ভালো নয়। এর জন্য হয়তো অনেক বড় বড় সুযোগ মিস করেছে অনেকে এবং ভবিষ্যতেও করতে পারে।এভাবে এক একটি ভয় নিয়ে চিন্তা কর, এবং সেটার রিএ্যাকশন, ও রিএ্যাকশনের ফলাফল সংক্ষেপে লেখ।ক্রমশ বড় হয়ে আমরা কলেজে ভরতি হলাম।
ট্রেনে একবার কলেজ থেকে বাড়ি আসার সময় রাজু ট্রেন থেকে পড়ে গেল।বিশু বলল, ওর স্বভাবটা খুব খারাপ। শুধু গেটের বাইরে মাথা নিয়ে মাস্তানী দেখাবে।অনিতা বলল, এখন আর ওরকম বলিস না। আমার রাজু মরে গেল নাকি দেখ।জীবন বলল, তোর রাজু মানে? আমাদের নয় নাকি।অনিতা বলল, আমরা দুজনে দুজনকে ভালবাসি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না।বিশু বলল, আমরা পরের স্টেশনে নেমে উল্টোদিকে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজব লাশ।জীবন বলল, থানায় একটা খবর দিয়ে দি। আমার কাছে মোবাইলে থানার নাম্বার আছে।ট্রেনের ভিতরে একটা গুঞ্জন। একজন বলছে, দেখ কোন বন্ধু হয়ত ঠেলে ফেলে দিয়েছে।আর একজন বলছে, এই বন্ধুই হল কাল।
যত নষ্টের গোড়া এই বন্ধু।তাই বলে কি পৃথিবীতে বন্ধুত্ব বলে শব্দটা উঠে যাবে। ঠেলে যে ফেলবে সে ত বন্ধু নয় শত্রু। কে বোঝাবে বোকা পাবলিককে। অযথা বন্ধু শব্দের কদর্থ করার কোন অর্থ হয় না।িেতারপর ওরা পরের স্টেশনে নেমে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল রাজুকে। তখন সৎ পাবলিকের দল রাজুর মাথায় জল ঢেলে প্রায় সুস্থ করে তুলেছে। রাজু জ্ঞান ফিরে পেয়ে বলছে, অনিতা তুমি কোথায়। অনিতা রাজুর মাথাটা কোলে নিয়ে বসে সেবা করল।
বিশু বলল, দেখ পাবলিক দুরকমের। এক হুজুগে আর দুই উপকারি, বুদ্ধিমান, বাস্তববাদি পাবলিক। দুই নম্বরের সংখ্যাই বেশি। এরাই পৃথিবীর ভালমন্দ নির্ধারণ করার মালিক। এরাই ভগবান, আল্লা বা যিশু।
রাজু এ যাত্রায় বেঁচে গেল। পুলিশ অফিসার একটু বকাঝকা করলেন। তারপর বিশুকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন। রাজু বলল, আমার পকেটে জিয়োনীর মোবাইল ছিল। বারো হাজার টাকা দাম রে। মানি ব্যাগে পাঁচটা দু হাজার টাকার নোট ছিল। এখন কিছুই নেই।
জীবন বলল,জীবন ফিরে পেয়েছিস এই যথেষ্ট। মানি লষ্ট ইস নাথিং লস।
বিশু বলল,একদল মানুষ বিপদে মানুষকে ফকির করে দেয়। রেলে কাটা পড়লে তারা লাশের আঙুলের আংটি, গলার চেন আর মানি ব্যাগের খোঁজ করে। নিজে যে একদিন লাশ হয়ে পড়ে থাকতে পারে সেকথা তাদের মনে থাকে না। কেউ গাঁজা খেয়ে সাধুগিরি করে আবার কেউ বা গাঁজার টানে বাটপারি করে সুখ পায়। বড় বিচিত্র এই মনুষ্যজগৎ।
বিশুর দলে ঢুকে পড়েছিল ছুঁচ হয়ে নেপাল। লম্বা সুদর্শন চেহারা তার। অনিতা কলেজের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ছিল। তার পিছনে ঘুর ঘুর করত অনেক রোমিও। নেপাল ওই দলেরই ছিল। ধরেছিল জীবন। একবার পিকনিকের সময় অজয় নদীর শুখা বালুচরে নেপাল সুযোগ পেয়ে অনিতার গালে চুমু খেয়েছিল। জীবন শুনল, অনিতা বলছে, আমরা বিয়ে করে সিঙ্গাপুর যাব বলছ। সত্যি তো?
নেপাল বলল, আমার বাবা বড় ব্যবসাদার। বাবার ব্যবসার দেখাশোনার জন্য আমাকে ওখানে যেতেই হবে। তোমাকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যাব।
জীবন কথাটা বিশুকে বলেছিল। বিশু শুনে বলেছিল, রাজুকে এখন কথাটা বলিস না। দুঃখে আত্মহনন করবে। যখন ঘটনা ঘটবে জানতে পারবে এরই নাম জীবন। ঠিক নদীর মত। এক পাড় ভাঙ্গে তো আর এক পাড় গড়ে।
কলেজ জীবন শেষ হয়ে গেল। অনিতা নেপালকে বিয়ে করে চলে গেল সিঙ্গাপুর। ট্রেনে কোন এক পাগলের ছোড়া পাথরের ঘায়ে রাজুর ব্রেনে আঘাত লেগেছিল। বিশু এর মধ্যে রহস্যের গন্ধ পেয়েছিল কিন্তু কুল কিনারা করতে পারে নি। তারপর দশ বছর কেটে গেছে। এই দশ বছরে কেউ চাকরি পেয়েছে কেউ পায় নি।
বিশু চাকরি পায় নি। বিয়ে থা করে নি। একদিন রাস্তায় দেখা পেয়ে বসলাম চায়ের দোকানে। সেই চা ওয়ালা কোথায়? কলেজ জীবনে এখানে এসে বসলেই খুড়োর আদর পেতাম। তিনি পরম মমতায় আমাদের ডিমরুটি আর চা খাওয়াতেন। জিজ্ঞাসা করতে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলল, আমি তার ছেলে। বাবা মরে গেছেন। এখন আমি দোকান চালাই। কলেজের ছেলেমেয়েরা এখনও এখানে আসে, বসে, চা পান করে। কথা বলতে বলতে বিশু হঠাৎ এক পাগলকে দেখতে পেল। চায়ের ছেলেটির কাছে এসে ইংরাজীতে পাগলটি বলল, গিভ মি এ কাপ ওফ টি।
—এই নে, যা যা
বিশু বলল,ওকে একটা ডিমরুটি দাও। পয়সা আমরা দিচ্ছি।
দোকানের ছেলেটি বলল, ও রোজ এখানে একবার আসে আর বলে, অনিতা তুমি ভাল আছ? আই লাভ ইউ।
বিশু বলল,ভাই ও শিক্ষিত। আমাদের বন্ধু। কলেজে এক সঙ্গে পড়তাম।
ছেলেটার হাত থেকে এক কাপ চা পড়ে গেল মাটিতে। তার চোখে বিস্ময়ের ছাপ। সে হয়ত মনে মনে একটা মনগড়া কাহিনী ফেঁদে বসল। মানুষের মন তো। মন তো নয় এক উপবন, রহস্যে ঘেরা।
আমার বরাবরই বুদ্ধি একটু কম। বুঝতে সময় লাগে বেশি। বিশু বলল, আমাদের রাজু।
আমি বললাম, পাথরের আঘাতে বেচারা পাগল হয়ে গেছে।
বিশু একটু চুপ থাকল। তারপর বলল, পাথরের আঘাতে মাথা ভাঙ্গার থেকে মন ভাঙ্গার যন্ত্রণা অনেক বেশি। সবাই বইতে পারে না মাথায়। তাই হয়ত পাগল হয়ে যায় ।
বিশু পাগলকে নিয়ে চলে এল ডাঃ হরমোহন সিংহের তৈরি মানসিক চেম্বারে। সেখানে বিনা পয়সায় পাগলদের রেখে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা আছে। আমি ছিলাম সঙ্গে। সেখানে সমস্ত রকম চিকিৎসা করার কথা বলে বিশু আর আমি চলে এলাম আমার বাড়ি।
আমার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করে দুপুরে আমরা রাজুর করুণ পরিণতি নিয়ে আলোচনা করলাম। কারও দোষ নয়। আমরা সবাই নিজের কৃত কর্মের ফলে ডুবে মরি। কর্মফলে জীবন গড়ে আবার কর্মদোষে জীবন ভেসে যায় অলকানন্দা জলে। তবে কি রাজু ভালবেসে ভুল করেছিল। সকলে ভালবেসে কি অসফল হয়? না, শতকরা দশ শতাংশ অসফল হলেও বেশিরভাগ মেয়েরা করুণাময়ী। তারা আছে বলেই পৃথিবী এত মোহময়। তাদের ছাড়া আমাদের জীবন যৌবন যে অচল।
সিঙ্গাপুরে অনিতা বরকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিল। তাদের ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে একটা ছেলে। জীবন এখন কর্মসুত্রে সিঙ্গাপুরেই থাকে। পৃথিবী বড্ড ছোট। ঘুরতে ঘুরতে একটা মলে দেখা হয়ে যায় জীবনের সঙ্গে অনিতার। জীবন বল, কি রে কেমন আছিস এখন।
অনিতা বলে, আর বলিস না রে। নেপাল বড়লোকের ছেলে। আরও কত সুন্দরী মেয়ে ওর সঙ্গি। বাড়িতে নিয়ে আসে। বিছানায় আমার সামনেই ফুর্তি করে। মদ খেয়ে মাতাল হয় ওরা সবাই।
জীবন বলে, বলিস কি রে। এ তো ভয়ানক ব্যাপার। তুই রাজি থাকলে আমি তোকে গ্রামের বাড়ি দিয়ে আসতে পারি। ছেলেও সঙ্গে আছে। পালিয়ে চল।
অনিতা বলে, তাই চল। ওখানে গিয়ে ফোন করে দেব। নেপাল খুশি হবে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।খুব ভুল করেছি রাজুদাকে দুঃখ দিয়ে। সে কেমন আছে।
জীবন বলে, বিশুর মুখে মোবাইলে শুনলাম, সে পাগলা গারদে আছে।
অনিতা বলে, আমি প্রায়শ্চিত্ত করব। আমি ওকে সারিয়ে তুলব আমার সমস্ত অলংকার বিক্রি করে। আমাকে বাঁচা জীবন।
কয়েকদিনের মধ্যে রাজু খবর পেয়ে গেল আপদটা বিদায় হয়েছে। সে ডুবে গেল কামসাগরে। আজ রোদবেলায় তার অন্দকারের কথা মনে নেই। সে জানে না যৌবনের গর্ব, অর্থের জোর বেশিদিন থাকে না। কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যায় অহংকার।অনিতা বাপের বাড়ি এসে বাঁচল। চোখের সামনে নিজের স্বামীর অনাচার কজন মেয়ে সহ্য করতে পারে। সঠিক সিদ্ধান্তে সে বিশুর কাছে ঠিকানা নিয়ে চলে এল সুদপুর মেন্টাল হসপিটালে। প্রথমদিন ডাক্তারকে বলে কথা বলার চেষ্টা করল। রাজু তাকে চিনতে পারল না। শুধু তার কথাটা বলল একঘেয়ে সুরে। আমি তোমাকে ভালবাসি অনিতা। আই লাভ ুইউ ইভেন নাউ। ডাক্তারবাবু বললেন, এই কথাটা ও বারবার বলে। আচ্ছা বলতে পারেন, এই অনিতা কে?
অনিতা গোপন করল না কোন কথা। সে সমগ্র ইতিহাস খুলে বলল। নিজের সম্মানের থেকে বড় এখন রাজুর সুস্থতা। যা করেই হোক তাকে সারিয়ে তুলতে হবে।
ডাক্তারবাবু বললেন, ভাল হল। আপনি আসবেন মাঝে মাঝে। আমাদের চিকিৎসার সুবিধা হল। আশার আলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে এটা হবে সময়সাপেক্ষ চিকিৎসা।
অনিতা সম্মতি জানিয়ে দিল। রাজুকে বলল, আমি তোমার অনিতা। আমি ফিরে এসেছি তোমার কাছে। কলেজের কথা মনে পড়ে তোমার। চায়ের দোকানের কথা, ঝাউবনের কথা। চুপি পাখিরালয়ের কথা। নৌকায় ঘোরার কথা। রাজু চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকারে ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলে অনিতা।
ডাক্তারবাবু বলেন, ও আর সহ্য করতে পারবে না। আমরা আবার আপনাকে ডেকে পাঠাব। প্রয়োজনে রাজু আর আপনাকে নিয়ে যাব চায়ের দোকান, চুপি পাখিরালয়। সব স্মৃতি রাজুর মনে গেলেই ও সুস্থ হয়ে উঠবে। আপনি আশা রাখতে পারেন আমাদের ওপর। অনিতা অন্যান্য প্রয়োজনের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা ডাক্তারবাবুর হাতে দিল। ডাক্তারবাবু বললেন, আমরা চিকিৎসাবাবদ টাকা নিই না। তবে এই টাকা আমরা দান হিসেবে গ্রহণ করলাম।
অনিতা যখন ফিরে এল তার বাচ্চাটা তখন তার মায়ের কোলে। এখানে সে স্বাধীন। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ালো অনিতা। আর অনিতার মা এক গ্লাস দুধ মেয়েকে খাওয়ালেন। অনিতার চোখে জল। অনেকদিন পরে আবার নতুন করে বাঁচার ইচ্ছেটা জাগ্রত হল।
জীবন আর বিরাজুল সিঙ্গাপুরে চাকরি পেয়েছে। তারা বিয়ে থা করেনি। একা অগোছালো সংসার। একজন মাসি আছেন। তিনি রান্নাবান্না করেন। কাজকর্ম যা করেন যথেষ্ট। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে মাসিকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। একদিন জীবন ছুটির দিনে মাসির বাড়ি গেল। মাসি গরীব হলেও বেশ রুচিশীল। মাসির এক ছেলে। স্বামী দিন মজুর। তবু বাড়িতেমএকটা শান্তির পরিবেশ।
মাসির ছেলে পাশের বাড়ির রীতাকে ভালোবাসে। জীবন বাইরে এসে মাসির ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতেই একমুখ হাসি।
— কি গো রতন, তুমি কি রীতাকে ভালোবাসো।
—- হূঁ, মিছে কথা বলব না। রীতাও আমাকে পছন্দ করে।
জীবন একথা জেনেছিল রীতার মুখে। মাসির অবর্তমানে রীতা একদিন জীবনের ঘরে কাজ করতে গিয়েছিল। জীবনের বেশ ভালো লাগছিল। সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়ে। তাকিয়ে দেখছিল বারে বারে জীবন। রীতা বেশ স্মার্ট মেয়ে। সে ঘুরে তাকিয়ে বলেছিল, আমাকে একজন নিয়ে যাবে বলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিই।
জীবন বলল, ও কে হয় তোর।
রীতা বলল,বুঝে নাও, কে হতে পারে। আমার সঙ্গে বিয়ে হবে ওর। আমার হবু বর।
এই বলে খিল খিল করে হেসেছিল।
জীবন অনেকদিন পরে মাসির মুখে শুনেছিল তার ছেলে মরে গেছে এক অপয়া সকালে। রাতে হয়ত চুরিডাকাতি করত। ভাগাভাগির অমিল হওয়াতে খুন করেছিল ওই ডাকাতের দল আমার ছেলেকে। মাসি হাওমাও করে কাঁদতে শুরু করেছিল জীবনের ঘরে। জীবন জানে না এখন বিরাজুল কোথায় থাকে? সিঙ্গাপুর তো ছোট জায়গা নয়। থাকলে একবার বিরাজুলের সঙ্গে দেশে যেত।
আমার কথা বলতে গেলে আমার জীবন জুড়ে রয়েছে মায়ের স্মৃতি। মায়ের বান্ধবী সবিতাদেবী ও আমার পছন্দের মহিলা। এই দুইজনের কথা কখনও ভুলতে পারব না। আমি সাজিয়ে গুছিয়ে কিছু কথা বলতে পারি না। বেশিরভাগটাই অপ্রকাশিত থেকে যায়।
সবিতা দেবীর বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। শরীরের নানারকমের অসুখ বাসা বেঁধেছে ডাক্তারবাবু বলেছেন কিডনি,হার্টের যা অবস্থা, বড়জোর আর কয়েকদিন বাঁচবেন। ছেলে একটা প্লাসটিকের গামলা কিনে দিয়েছে। বাথরুম শোবার ঘরের থেকে অনেক দূরে। ওই গামলায় পেচ্ছাপ করা যাবে। কিন্তু পায়খানা যেতেই হবে দূরে। ফলে রাতে দরজার তালা খুলে উঠোন পেরিয়ে বাথরুম যেতে হয়। তখন স্বামী বারবার বলেছিলেন,তোমার ঠাকুর ঘরের পাশেই বাথরুমটা হলে বুড়ো,বুড়ি আমাদের দুজনেরই সুবিধা হবে। কিন্তু সবিতারাণী রাজী হন নি।
তিনি বলেছেন,ম্লেচ্ছ,নোংরা লোকের মতো কথা বলো না। ঠাকুর ঘরের পাশে আবার বাথরুম হয় নাকি? স্বামী বলেছিলেন,তাহলে মানুষের শরীরটাতো বাথরুমের থেকেও নোংরা। সবিতাদেবী তর্ক করেন নি আর। শুধু বলেছিলেন, দূরেই করো। সব মনে পরছে তার। স্বামী বারো বছরের বড় ছিলেন। আগেই চলে গেলেন মহাসিন্ধুর ওপাড়ে।
তাঁর স্বামী বড়ো অভিনেতা ছিলেন।সবিতাদেবীকে বলতেন, তিরস্কারের থেকে জীবনে পুরস্কারই বেশি পেয়েছি। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। এর থেকে বড় পুরস্কার আমার অভিধানে নেই। আমার যোগ্যতার বেশি, তার পরিমাণ। ঈশ্বর সময় হলেই প্রত্যেকের যোগ্য পাওনাটুকু দিতে ভোলেন না। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য আর সহনশীলতা। সময় কিন্তু কারও কথায় এগিয়ে আসবে না বা পিছিয়ে যাবে না।
অভিজ্ঞ লোকেরা প্রথমে ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। অন্য মানুষকে সহ্য করা, সম্মান করা ধর্মেরই নামান্তর। মানুষের জন্যই মানুষ। শুধু শুকনো লোক দেখানো ধর্ম যা মানুষকে ছোটো করে সেটা কখনই ধর্ম হতে পারে না। ধর্ম হচ্ছে অণুবিক্ষণের মতো। ছোটো জিনিসকে বড়ো করে দেখে।
সবিতাদেবীর মা ছিলেন গ্রামের লক্ষীদেবী। তার দান,ধ্যানের জন্য সকলেই খুব ভালোবাসতো। মনে পরে সবিতাদেবীর মায়ের কথা। তিনি বলতেন,কথিত আছে কোজাগরি লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোনো অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী। ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ।
আমার মায়ের মূল লক্ষ মানুষের সেবা করা। হয়তো তিনি আশ্রম করে যেতে পারেন নি। কিন্তু প্রত্যেক পুজোতে গরীব মানুষকে পেট ভরে প্রসাদ খাওয়াতেন। বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন।
লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তারফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে।
প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। প্রত্যেক প্যান্ডেলে যদি নর নারায়ণ সেবা হতো তাহলে আরও ভালো লাগতো। সবিতাদেবী কথা বলার সঙ্গী পান না। তাই বসে বসে নিরালায় পুরোনো দিনের কথা ভাবেন।
পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেতো। বিরাজুল, ফতেমা আসত আমাদের বাড়ি। তাদের অনুষ্ঠানেও আমরা যেতাম। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নীচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকা দি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা,রুনু, শংকরী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্,গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে।
পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনেআছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা। তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি
বিশাখাদি বলল,বিধবা হয়ে মাংস খাব। ভয় লাগছে।
মা বললেন, কিসের ভয়। তোর মন চাইছে। তাহলে আপত্তি নেই।কুসংস্কার ভেঙে বাস্তবে ফিরে আয়। যেকোনো বিশ্বাস বা অভ্যাস – যেমন, এটি অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়, বিজ্ঞান বা এর কার্যকারিতা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হওয়া, ভাগ্য বা জাদুতে ইতিবাচক বিশ্বাস অথবা যা অজানা তা থেকে ভয় পাওয়া। এছাড়াও “কুসংস্কার” বলতে ধর্মীয় বিশ্বাস বা অযৌক্তিকতা থেকে উদ্ভূত কর্মকাণ্ডকে বোঝায়।
কুসংস্কার শব্দটি প্রায়ই একটি নির্দিষ্ট সমাজের অধিকাংশের দ্বারা অনুসরণ না করা ধর্মের কথা বলে ব্যবহৃত হয়, যদিও প্রথাগত ধর্মের মধ্যে কুসংস্কার রয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এটি সাধারণত ভাগ্য, ভবিষ্যদ্বাণী এবং নির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক জগতের বিশেষ করে বিশ্বাস এবং অভ্যাসগুলির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, বিশেষ করে এই ধারণাটি যে নির্দিষ্ট পূর্বের ঘটনাগুলি দ্বারা ভবিষ্যতের ঘটনাগুলির জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করাকরা হয়। বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো।
সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না। যে যারইচ্ছেমতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালা সোনার দেকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না।
কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপাড়ে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী। স্বামী বলতেন তার মায়ের কথা। তিনি বলতেন,আমার মা সাধনায় ছিলেন রামপ্রসাদ। মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে দিতে গেয়ে উঠতেন রামপ্রসাদি। নিরামিষ মা কালীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ছেলেদের নিয়ে সংসার চালাতেন জীবনানন্দ ছন্দে। অভাব থাকলেও কোনোদিন তার ছাপ পরেনি মায়ের চোখেমুখে।
আসল মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছিলেন পুজোর আসনে বসে। কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো না সেসব কথা। তার চলনে, বলনে ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি। মাকে দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের। দাদু মাকে মা বলেই ডাকতেন। তিনি সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন। মায়ের গান শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে। একবার বৈশাখি ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো। মা বললেন,তোদের দাদুর আত্মা মুক্তি পেলো।
অই ডালে বাঁধা ছিলো দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি। অবশ্য এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক। বুড়ি ঠাকুমা সেদিন কেঁদে উঠেছিলো জোরে। ঠাকুমা বলে উঠলেন,চলে গেলো,ও চলে গেলো। কোনো কিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবু কিছু ঘটনা বার বার তার অস্ত্বিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়। একটা দেশি কুকুর আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটে থেকে।
তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা,পূর্ণিমায় কিছু খেতো না। রক্ষাকালী পুজোয় উপবাস করতো। তার সামনে খাবার দিয়ে দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না। শুধু কথা বলতে পারতো না। কিন্তু ভাবে, ভঙ্গিমায় সব বেঝাতে পারতো মানুষের মতো। মা বলতেন,পূর্বজন্মে তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো। তাই তোর আমাদের বাড়িতে আগমণ। যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো সারা পাড়ার বাসীন্দা।
তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে। কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার সারা জীবন ধরে পালন করা ব্রত,উপবাস। বলবে,কাকতালীয়। সেসব তো এক আধবার হয়। সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয় না।বিজয়ার সময় আমার মা আমাদের পোষা কুকুর জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন। ধান রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা। তারপর সাপুড়ে ডেকে সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড়দার বিছানার মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো। কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পরতো নিঃস্বার্থ ভাবে। প্রত্যেক প্রাণীর কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।
স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পরেছিলেন তিনি। মনে পরতো তার আদর। প্রথম ফুলশয্যার রাত। কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এবাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু,ঘুঘুর ঘু। সবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার খুব ভাব। মনে হয় স্বামী ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেন।
ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলু সবিতাদেবীকে দেখে। কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলের বৌ বল,বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়। বুড়ি বলে,ও ঘুঘুর ঘু,বলে না। বলে,এবার আয়,এবার আয়। নাতি এসে মাঝে মাঝে ঠাকুমার কাছে বসে। আর ঘুঘু পাখিটার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলে,এবার আয়। ফতেমার বাবা হুমায়ুন চাচা ছিলেন সংসারের বন্ধু।তাদের বিপদে আপদে খবর নিতেন।
নদীর ধারে বসে জলে পা ডুবিয়ে খেতাম। নদীর জল হেঁট হয়ে বসে চুমুক দিয়ে পান করতাম। পায়ে বিভিন্নরকমের রঙীন মাছ চুমু খেয়ে যেতো। আমরা মুড়ি খাওয়ার পরে গামছা করে রঙীন মাছ ধরতাম। আবার ছেড়েও দিতাম। তারা সাঁতার কেটে খেলা দেখাতো।
ভূতের গল্প শুনে নাতি ঠাকুমার কোল ঘেঁষে বসতো। ঠাকুমা বলতেন,ভয় কি আমি তো আছি। ঠাকুমা সবিতা দেবী ঠাকুরকে বলেন,আর একবার সময়ের চাকাটা উল্টোদিকে ঘোরানো যায় না। তাহলে আবার ছোটো বয়সটা পাওয়া যাবে। নদীর জল খাওয়া যাবে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠে, মাঠে ঘোরা যাবে। ঘু ঘু পাখিটা বিজ্ঞের সুরে বলে,না না না, ঘুঘু, ঘুঘু।
আজ সকাল থেকে সবিতাদেবী উঠোনের রোদে বসল আছেন। ছেলে অফিস যাওয়ার আগে আজকে প্রণাম করলো। কোনোদিন করে না তো। তিনি আশীর্বাদ করলেন ছেলেকে প্রাণভরে। ছেলে বললো,সাবধানে থেকো। আজ ওরা পিকনিক করতে যাবে পুকুরের ধারে। ছেলে চলে গেলো।এখন শীতকাল। পিকনিকের সময়। সবিতা দেবী উৎসাহ দিতেন, যাবে বৈকি।
নিশ্চয় যাবে। তারাও যেতেন। যুগে যুগে পরম্পরা এইভাবেই তো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ভাবেন সবিতাদেবী। বৌমা নাতিকে দিয়ে একবাটি মুড়ি,তরকারী নামিয়ে দিয়ে গেলো।
ঠাকুমা খিদে পেলে খাবে। ঠাকুমা বললেন,বেশ বাবা। তোমরা যাও। আমি ঠিক খেয়ে নেবো। মনে পরে গেলো একবার ফাঁকা বাড়ি পেয়ে রান্না করে খেয়েছিলেন। পুড়ে গেছিলো তরকারীটা। সেই প্রথম রান্নার অভিজ্ঞতা। তারপর দুপুরবেলা তালবোনা পুকুরে সাঁতার কেটে তাল কুড়িয়ে এনেছিলেন। সব মনে আছে। আরও মনে পরছে পাড়ার ধীরেন ফাঁকা বাড়ি পেয়ে তার কাছে এসলছিলো। খুব ভালে ছেলে। অনেক গল্প হয়েছিলো। একটা চুমু খেয়েছিলো। আর কিছু নয়। বলেছিলো, সারা জীবন এই স্মৃতি মনে থাকবে তার। ধীরেন এক বছর পরে ক্যান্সারে মারা গেছিলো। কিন্তু কিশোরী সবিতার কাছে সে অমর হয়ে আছে।
সবিতা দেবী এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে যৌবনে বিকেলে যখন বেড়াতে যেতেন তখন সবাই তাকিয়ে দেখতো। ছেলে বড়ো। মেয়ে ছোটো। মেয়েকে অনেকে ভালোবেসে চকলেট দিতেন। মেয়ে আর একটা হাত পেতে বলতো,আর একটা দাও। দাদা খাবে। ছোটো থেকে আমরা সবাই ভাগ করে খাবো, এই আদর্শে মানুষ তার ছেলে মেয়ে। ভারতীয় দর্শন তো সেই কথাই বলে। স্বামী অসীম চাকরী করতেন বেসরকারি একটা কারখানায়।
ম্যানেজার ছিলেন তিনি। ছোটো থেকে নিজে অনেক কষ্ট করেছিলেন। মুদিখানা দোকান ছিলো তার বাবার। বৃদ্ধবাবা, বাজার যেতে পারতেন না। তখন রাস্তায় ছিলো মাটির ধুলো। বৃষ্টি পরলে কাদায় পিছল হয়ে যেতো পথ। তবু মাথায় করে বয়ে আনতেন নুনের বস্তা, যার ওজন ছিলো ষাট কেজির মতো। অমানুষিক পরিশ্রম করে বড় হয়েছিলেন তিনি। পেট ভরে দুবেলা খাবার জুটতো না। সবিতাদেবীর খুব খারাপ লাগতো। তাই তিনি তার দাদা, দুকড়ি কে সব কথা খুলে বলেন। দুকড়ি দাদা কলকাতায় কাজ করতেন। অনেক মাড়োয়ারি, কারখানার মালিকের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিলো। তিনি অসীমকে একটা কারখানার ম্যানেজার পদের চাকরী জোগাড় করে দিলেন।
অসীম নিজের দুঃখের কথা ছেলেমেয়েদের কোনোদিন বলেন নি। তিনি ছেলে ওমেয়েকে জমিদারের সন্তানের মতো মানুষ করেছিলেন। ঝুলনের দিনে পুতুলে ভর্তি হয়ে যেতো ঘর। ছেলেমেয়েরা ঝুলন সাজাতো। আর অসীমবাবুর খুব ভালো লাগতো। ছোটোবেলার নিজের না পাওয়ার দুঃখ তিনি ভুলে যেতেন। দোলের সময় ছেলে মেয়েকে কিনে দিতেন নতুন জামা। সেই জামা পরে তারা দোল খেলতো। মিষ্টি,মাংস, ফল কিছু বাকি থাকতো না। কত লোক আসতো তার বাড়িতে রং মাখাতে। তারপর মিষ্টিমুখ করে ফিরে যেতো রাম রাম বলে। আমরা শ্রদ্ধেয় লোককে দেখে যেমন নমস্কার করি। যারা হিন্দীভাষী তারা শ্রদ্ধেয় গণ্যমান্য লোককে দেখলে বলে,রাম রাম রায় বাবু।
লিলুয়া শহরে পটুয়াপাড়ায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন অসীমবাবু। তারপর একদিন তার গ্রামের ভাই মরে গেলো কম বয়সে। জীবন ওলট পালট হয়ে গেলো। চাকরী ছেড়ে আবার চলে গেলেন গ্রামে। জমানো পয়সা,সোনাদানা সব খরচ হয়ে গেলো। ধার, দেনা করে কোনোরকমে একটা দোকান করলেন। মুদিখানা। আবার শুরু হলে জীবন সংগ্রাম। মেয়ের বিয়ে হলো কোনোরকমে। ছেলের তখনও চাকরী হয় নি। শরীরের ওপর চাপ খুব বেশি হয়ে পরলো। তার ফলে অল্প বয়সে মারা গেলেন তিনি। এবার দোকান চালায় ছেলে। দোকান বেশিদিন চালাতে হলো না। ছেলে চাকরী পেলো। সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিলো সবিতাদেবীর।মনে পরে তার, একবার সুতিকা হয়েছিলো তার।
পেট ফেঁপে যেতো। বারবার পায়খানা যেতে হতো। তখন মাঠে,ঘাটে সারতো সবাই। শ্বশুরমশাই খাল কেটে দিয়েছিলেন। তারপর শুয়োগাছি গিয়ে সাধুবাবার কাছে শেকড়,বাকড় খেয়ে বাবা ভূতনাথের দয়ায় অসুখ ভালো হয়েছিলো। শুয়োগাছি থেকে আসার সময় মেয়েটাকে সারা রাস্তা কাঁধে করে এনেছিলো ছেলে। বাড়িতে এসে দেখলেন,শ্বাশুড়ি মরে গেছেন। শ্বাশুড়ির ছোটো মেয়েটা ভুগছিলো খুব। কাঠির মতো শরীর হয়ে গেছিলো। শ্বশুর বললেন সবাইকে,ওর মরদেহের সঙ্গে মেয়েটাকেও বেঁধে দাও।
ও তো আর কদিন পরেই মরবে। কিন্তু সেই মেয়ে বড়ো হয়ে গ্রামের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হয়েছিলো। রাখে হরি মারে কে? সবিতাদেবী ভাবেন ঈশ্বরের করুণার কথা। যাইহোক,চাকরী পাওয়ার পরে ছেলের বিয়ে দিলেন সবিতাদেবী। এখন ছেলে,ছেলের বৌ আর নাতি এই নিয়ে তার সংসার। কোনো কিছুর অভাব নেই। তবু সবিতাদেবীর মনে হয়,আগের দিনগুলোই ভালো ছিলো। অভাব থাকলেও শান্তি ছিলো হৃদয় জোড়া। যাইহোক এখন বয়স হয়েছে। ভালোমন্দ সব সমান মনে হয়।
বাথরুম যেতে গিয়ে কলতলায় পা পিছলে পরে গেলেন সবিতাদেবী। বুকটায় খুব ব্যাথা করছে। ঘুঘু পাখিটা নিচে নেমে এসেছে গলা কাঁপিয়ে কি দেখছে পাখিটা। তিনি ভাবছেন,আমাকেই দেখছে। একি হলো। আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?। চিৎকার করার ইচ্ছে হলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। তার বাবা,মা,স্বামীকে এবার দেখতে পাচ্ছেন। আর দেখছেন,তিনি ঘুঘু পাখি হয়ে গেছেন। একটা শীর্ণ শরীর পরে আছে কলতলা জুড়ে। তার শরীর বেশ হাল্কা লাগছে। ঘুঘু পাখিটার সঙ্গে উড়ে চলে গেলেন খোলা আকাশের নীচে।
সন্ধেবেলা ছেলে,বৌমা,নাতি এসে দেখে,মা পরে আছে কলতলায়। শরীর কাঠ হয়ে গেছে। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে এলো বারান্দায় দড়ির খাটে। আর চাদর,বিছানা নষ্ট করে লাভ নেই। বৌমা ভাবছে। নাতি বললো,একটা চাদর ঢাকা দাও ঠাকুমাকে। ঠান্ডা লাগবে। ছেলে একটা সাদা শাড়ী এনে ঢাকা দিলো। তারপর পাড়ার লোকজন এসে নিয়ে গেলো শ্মশানে। সব মিটে গেলো পনেরো দিনের মধ্যেই।
এখন ছেলে একা। তার ছেলেও বড়ো হচ্ছে। সমানে অনন্তকাল ধরে চলেছে এই প্রবাহ। ছেলে ভাবছে,মা নেই,বাবা নেই।মন খারাপ। এবার তার মনের খবর কে নেবে?মায়ের কাছে সময় দিতে পারেনি। শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। আর এই কাজ শেষ হলে সেও একা হয়ে পরবে। আজ কবি বন্ধু বাড়িতে এসেছে। বেশ ভালো লাগছে। বন্ধু বলছে,জন্ম, মৃত্যু তো থাকবেই।
আমি বললাম, এক নাগাড়ে বকে গেলি অনেকক্ষণ। বন্ধু বললো, তুমি আরও কিছু বলো। সেই জন্যই তোমার কাছে আসা। আমি আবার বলতে শুরু করলাম,আমার কথা আমার গোপন কথা। আমার অনুভবের কথা। কবি বন্ধু আমার কথা শুনতে ভালোবাসে। সে সংসারী। তবু সব কিছু সামলে তার কবিতা তো লিখে চলে।
আমি বন্ধুকে বলতে শুরু করলাম শরত জীবনের কথা। এবার আমার জীবনের পরবর্তী অঙ্ক শুরু।
তারপর শুরু হলো আমার জীবনের রোজ নামচা। আমি ট্রেনে এখন রবির সঙ্গেই যাওয়া আসা করি। রবির সঙ্গে আমার খুব ভাব। অন্তরঙ্গ বন্ধু আমার। তাছাড়া ধীরে ধীরে আরও বন্ধু হলো। রবি বললো,শোন আমার একটা কবি সম্মেলনের আলোচনার কথা। এই ট্রেন জার্নির অভিজ্ঞ তার কথা।
রবি বলছে, যে সব মানুষ অন্ধ, খোঁড়া কিংবা বার্ধক্যের কারণে মানুষের সাহায্য চেয়ে বাঁচতে চান তারা ভিখারি নন।
একটা সাহিত্য সম্মেলনে রবি বক্তব্য রাখছিলো। বিষয় হলো, ভিখারি- আপনার চোখে। স্টেজে উঠে গল্পটা বলছিলো।
সবাই একবাক্যে বলে উঠলেন, বলুন, আমরা শুনতে চাই।
রবি বলছে, যাদের প্রচুর আছে অথচ সামান্য পেনশেন ভোগীর কাছে ঘুষ নেয়, বিধবা মহিলাকে মৃত স্বামীর জমানো হক্কের টাকা পাইয়ে দেবার আগে তাকে শোষন করে ছারপোকার মতো তারাই প্রকৃত ভিখারি। এবার আমি আমার লেখা গল্প পাঠ করছি।
আমার বন্ধু আমার সঙ্গেই আসা যাওয়া করতেন। তিনি থাকলে আমার একাকিত্ব দূর হতো। দুজনে গল্প করতে করতে সময় কখন যে পার হয়ে যেতো বুঝতেই পারতাম না।আর এক বন্ধুর নাম সুকুমার। সুকুমার বললেন, দেখুন ট্রেন চলাকালীন বাইরের দৃশ্য মনোরম। দুর্গাপূজা হয়ে গেছে। কাশফুলগুলো মন খারাপ করে মাথা দোলানো বন্ধ করেছে। বৃষ্টি হয়ে গেলো। একটা ভ্যাপসা গরম মন আরও বিষন্ন করে তুলেছে।
বন্ধু আর আমি কথা বলতেই ব্যস্ত। বড়ো ভালো লাগে ট্রেনের এগিয়ে যাওয়ার গতি। তারপর স্বস্থানে ফিরতে হবে সবাইকে।
আমার চোখে ট্রেনরর কামরাটা গোটা পৃথিবী হয়ে উঠেছে। লন্ডন থেকে আসা লাল রঙের লোকটা নবদ্বীপে নেমে গেলো হরে রাম, হরে রাম ধ্বনি দিতে দিতে। তারপরই বিষ্ঞুপ্রিয়া হল্ট। আর সেখান থেকেই আধঝুড়ি আপেল নিয়ে এক বিক্রেতা উঠলেন।
তিনি হেঁকে চলেছেন, আপেল, কাশ্মীরী আপেল। এক কেজি সত্তর,পাঁচশো চল্লিশ টাকা। দেবো নাকি? ডিলিশাস, খেয়ে দেখুন।
এদিকে শসাওয়ালা বলছেন, দেবো নাকি ছাল ছাড়িয়ে,নুন মাখিয়ে…
—- না না ষাট টাকার বেশি দেবো না।
তারপর অনেক কথা ক্ষয় করে বাবুটি পাঁচশো আপেল নিলেন। তারপর আমরা দুজনেই দেখলাম পঞ্চাশ টাকা তার হাতে দিলেন।
স্টেশনে এবার নামতে হবে। তাড়াতাড়ির মাথায় আপেলওয়ালা একশো টাকা মনে করে পঁয়ষট্টি টাকা ফেরত দিলেন বাবুটিকে।বাবু অম্লান বদনে নিয়ে নিলেন টাকা। আমরা দুজনেই প্রতিবাদ করলাম। আমি বললাম, আপনি তো পঞ্চাশ টাকা দিলেন। তাহলে কোন আক্কেলে আবার এতগুলো টাকা নিলেন।
বাবুটি সমানে তর্ক করে চলেছেন।
তারপর দেখলাম বাবু বিজয় গর্বে বলছেন, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে মশাই। একদম ফ্রিতে আপেল। তারপর আপেলে কামড় দিয়ে বললেন, আপনাদের দেখে নেবো।পরের স্টেশনে আমি নামবো। তারপর দেখছি।
আমার বন্ধুটি বললেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভিখারি আপনি। আপনার ক্ষমতা কই?আপনি তো নিঃস্ব রিক্ত। আপনাকে দেখে আমাদের দয়া হচ্ছে।
বাবুটি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। ওনার স্ত্রী চোখের ঈশারায় চুপ করতে বললেন স্বামীকে। পরের স্টেশনে ওনারা নেমে গেলেন।
বন্ধু বললেন, ভিখারি এরেই বলে…
আমার গল্প এখানেই শেষ। এই বলে রবি সকলকে নমস্কার জানিয়ে বসে পরলো।
ছোটোবেলার মজার কথা বলতে, ভাবতে খুব ভালো লাগে।সারা রাত পুজো দেখতে গিয়ে বন্ধুদের দলের একজনের খুব টয়লেট যাবার প্রয়োজন হলো। বন্ধু পড়লে লজ্জা পাবে। নামটা নকল বলি। হেগো, হাগুর জন্য ছটফট করছে। সামনে কোনো ব্যবস্থা নেই। হেগো কাপড়ে চোপড়ে হবার আগে প্যান্টের বোতাম খুলে ফেলেছে। একটা ড্রেনে বসতে যাবে এমন সময়ে বাড়ির মালিক বলছেন, একি আমার বাড়ির সামনে,খোলা স্থানে,আরে ছি, ছি,…
হেগো তখন মরিয়া। কাজ সাবাড়। মার ছুট। মেসো আমাদের বললেন, তোমরা চেনো।
আমরা বললাম, না না। ব্যাটাকে ধরতে পারলেন না।
—— কি করে ধরবো। জল নেই। তবু, শালার ঘেন্না নেই।
বন্ধু বিপদমুক্ত হলে আমাদের আনন্দ হয়েছিলো।
আবার সাঁতার শিখতে গিয়ে,ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে । এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে । ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে । হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা । কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি ।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে । রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ।ভালো থেকো বাল্য অনুভব ।
চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ ।আমি এইসব ভাবছি। এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা বড় পাঁঠা আমাকে গুঁতিয়ে জলে ফেলে দিলো। খুব রাগ হলো কিন্তু পাঁঠার সঙ্গে লড়াই করতে লজ্জা হলো। যদি কেউ দেখে ফেলে। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে। সবাই মনে করতো, ব্যাটারা গাঁজার ভক্ত নাকি। গাজনে একজন হনুমান সেজেছিলো। আমরা তার লেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম লোকটা রাগ করে নি। বলছে,লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো।
।রাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম,দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন,জানি না ভাই। তবে।।মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়,তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে।
তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর বালিশে দি। কেঁধো বললেন,মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই,দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।
অনেক বছর অপেক্ষা করেছি,দাদুর কথা শুনবো ওপাড় থেকে। যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন। কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। কথা শোনা তো দূর অস্ত। ট্রেন কাটোয়া ঢুকে পরেছে। যে যার নিজের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো। আমি বাড়ি এসেই খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পরলাম ফাঁকা মাঠে হাওয়া খেতে। বন্ধুরা সবাই বেড়াতে আসে মাঠে। গল্প গুজব করতে করতেই সবাই বাড়ি ফিরলাম। তারপর কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে। তারা চলে গেলে সপরিবারে রাতের আহার সারি।
সকাল হলেই বন্ধু আশীষের খোঁজ নিতে গেলাম। ও ফিরে এসেছে ভেলোর থেকে।
তার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম মুর্শিদাবাদের রামপাড়া। পাঁচুন্দির হাট থেকে গরু,, মোষ কিনে গঙ্গা পাড় হয়ে নিয়ে গিয়ে গ্রামে বিক্রি করত মুসলমান চাচারা। তাদের বাড়িও কতবার গিয়েছি আমরা। অনেক পুরুষধরে চলে আসছে আমাদের এই আত্মীয়তা।
গঙ্গার ধারে আশীষের গ্রামটি। এই গ্রামেও হিন্দু, মুসলমান বাস করে আসছে চোদ্দ পুরুষ ধরে।
ছোটো হলেও আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। কারো বাড়ি স্নান করা, কারও বাড়িতে খাওয়া দাওয়া।কারওবাড়িতে গান বাজনা করেই দিন চলে যেতো। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের দিনে নৌকা করে ঠাকুর বিসর্জন দেখলাম। গঙ্গার ধারের সব গ্রামের ঠাকুর নৌকো করে মাঝ গঙ্গায়এনে বিসর্জন করা হচ্ছে ঢাক,ঢোল বাজিয়ে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমেএলো। সন্ধ্যা নেমে এলো আশীষের জীবনে। রাত হওয়ার আগেই পাড়ি দিলো ভবসাগরের ওপাড়ে। তার সংসারে বাবা,মা, তিন বোন। আশীষের বাবাকে আমি জামাইবাবু বলতাম। তিনি কেলকাতা লালবাজারের কমিশনারের দপ্তরে কাজ করতেন। তার দাপ ছিলো ভীষণ।
তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। তিনি ছেলের শোকে মারা গেলেন। দিদি কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেলেন। বড্ড প্রাণপ্রিয় ছিলো তার আশীষ। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। রামপাড়ার বাড়িতে আর কেউ নেই। কতকগুলো ঘুঘু মনখারাপের ডাক ডেকে চলে নিশিদিন। ওই নিরীহ পাখি মানুষকে সত্য, সুন্দরের বাণী শোনায় আজীবন। বড্ড প্রিয় আমার এই ঘুঘু পাখি।
ভিটেতে ঘুঘু চড়ে না,সে মনে রাখে এই ভিটের মালিক একদিন আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো,আজও দিয়েছে। তাই কৃতজ্ঞ সুরে তার শোকপ্রকাশ মালিকের অবর্তমানে। আমার তাই মনে হয়। সত্য ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার নাম ধর্ম। জীবন একটা ছোটো নাটক। জলে একমুঠো দেহছাই ছড়িয়ে গেলেই সব শেষ। রবি বলে চলেছে তার আবেগ,তার ভাবনার কথা।
কি করে একটা সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায়। বন্ধু রবি বললো,তবু কিছু মানুষের এত অহংকার। তারা মনে করে মৃত্যু বোধহয় তাদের ভুলে গেছে। সে ভোলে না। হঠাৎ চলে আসে। সময় থাকতে বাড়ির কাছের মানুষের সেবা করাই ভালো। পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে,পরস্পরের সেবা, ভালোবাসার মাধ্যমে।
এখন ভিগো ভিডিও আর টিক টক এর যুগ। মোবাইলে ক্যামেরার সামনে নেকেড সিন বা বস্ত্র হরণের রমরমা। ভাইরাল হতে সময় লাগছে না বেশি। বিশু ভাবে, এরা তো অন্য কোন ভাবনায় যুক্ত হতে পারত। আবার ভাবে তাহলে হয়ত লক্ষ লক্ষ লাইক পেত না, ভাইরাল হত না ভিডিও। সে ভাবে আমাদের ছোটবেলায় এসব হত না। শুধু ছোটাছুটি আর খাওয়ার পালা। শক্তিমান সিরিয়াল দেখে টিভিতে সময় কাটত কিছুক্ষণ । বেশির ভাগ সময় মগ্ন থাকতাম আপন সৃষ্টিকর্মে। ছবি আঁকা, তবলা বাজানো আর গৌরীর প্রেমে হাবুডুবু খেতাম। কোনোদিন গৌরীর সঙ্গে সামনাসামনি কথা হয়নি। শুধু চিঠি চালাচালি হত ভোরবেলা।
আলের বার নেওয়া, বীজ মারা, মাদা, দুনি, মুনিষ, ছিটেন মারা, বীজ পোঁতা, নিড়েন দেওয়া এসব চাষবাসের আঞ্চলিক কথা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। হেমন্ত কাকা ও বড়দা,মদনকাকা কৃষিকাজে অভিজ্ঞ ছিলেন বলে গ্রামের সবাই পরামর্শ করতে আসতেন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। আমি ছোট থেকেই দেখেছি,
সন্ধ্যাবেলা মুনিষরা সকলে কাজের ফাই ফরমাশি শুনে সকালে জমিতে গিয়ে সেইসব কাজ করতো। জমি দেখতে সকালে জলখাবার নিয়ে যেতো বাড়ির ছোটোরা। দুপুরে যখন মুনিষরা ভাত খেতো সে দেখার মতো ব্যাপার হতো। বড়ে বড়ো জামবাটিতে ভরতি ভাত, মোটা তরকারি, ডাল, মাছ, চাটনি, কাঁচালঙ্কা আর পিঁয়াজ। কি সুন্দর শৈল্পিক ছোঁয়া খাওয়ার মধ্যে। কেটিপতিরা খাবার সময় এই আনন্দ পায় কি? আমার মনে হয় পায় না। খাওয়ার আন ন্দ পেতে গেলে খিদে চিনতে হয়। আর খিদের মতো উপহার পেতে গেলে দৈহিক শ্রমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হয়। তা বলে শুধু খিদের জ্বালায় জ্বলতে কার ভালো লাগে। কবে আসবে সেই দিন।
বড়দা বলতে শুরু করলেন তার বন্ধু ও সেই গ্রামের কথা, শরতের শেষ সময়। ধানগাছে দুধ হয়েছে। গ্রামবাসীদের খুব আনন্দ। আর ক’ দিন পরেই সোনার ধান ট্রাকটরে চেপে রাস্তা আলো করে ঘরে ঘরে ঢুকবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ছাড়া জলে ডুবে গেলো গর্ভবতী ধানগাছ। প্রকৃতি বিরূপ হয় না এতটা। মানুষের মনের কথা প্রকৃতি অনেক ভালো বোঝে। কথাটা বললেন, সহজ সরল মাটির মানুষ মদন কাকা।
মদন কাকা অনেক মজার কথা বলেন। কোথা থেকে জানেন জানি না। সুমিত বললো।সে আরও বললো, আমি এই গ্রামের ছেলে। ছোটো থেকেই দেখে আসছি মদন কাকার চলা ফেরা কথাবলা আর জ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডার। তার চিরকালের সঙ্গি রেডিও। যেখানেই যান রেডিও ছাড়া যান না। সব সময় খবর শোনেন। তিনি বলেন, রেডিও আর টিভির মূল বিষয় আমার মতে এই খবর বিভাগটি।
মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা তার ধর্ম।কত জটিল বিষয় তার কাছে জানতে গেলেই সহজ জলের স্রোতের তির তির শব্দে অন্তরে প্রবেশ করে অচিরেই। দুর্গাপুজোর পরেই সাধারণ মানুষর মনে একটা ঘুঘুর একঘেয়ে ডাক ডেকে চলে অনবরত। গ্রামবাসিরা সকলেই এই সময় একটু হাত, পা মেলে বসেন মুক্ত আকাশের বিহঙ্গের মতো। কোনো অভাবের দাগ থাকে না অন্তরে। এই গ্রামগুলোই ভারতবাসীর প্রাণ,গান। কায়স্থ পাড়াতেই মদন কাকার চোদ্দ পুরুষের ভিটে। বিশে ওই মদন কাকার গুষ্টিরই ছেলে।
লতায় পাতায় বংশবৃদ্ধির কারণে একটা বাড়ির লোকজন বেড়ে চোদ্দ পুরুষের লাইন ধরেএক একটা পাড়ার সৃষ্টি করেছে। কোনোটা ঘোষাল পাড়া, কোনোটা ডোম পাড়া,আবার কেনোটা ডেঙা পাড়া। এক একেকটা গ্রামে কুড়ি থেকে তিরিশটা পাড়া থাকে। হিন্দু, মুসলমান দীর্ঘকাল ধরে একসঙ্গে এই গ্রামগুলোতে বাস করে। একটা প্রবহমান সম্পর্কের সেতু বেঁধে রাখে এই গ্রামগুলি।
পাশাপাশি যত গ্রাম আছে চৈত্র মাসে গাজন উৎসবের সময় শিবের পুজোতে আনন্দে মাতে একসাথে। সমগ্র জেলা জুড়েই চলে এই মহাদেবের পুজো। অনেকে সন্ন্যাসী বা ভক্ত হয়ে সমস্বরে বাবার নামে ধ্বনি দেয়,বলো শিবো মহাদেব।
মদন কাকার মতো বয়স্ক লোকেরা পরিচালনা করেন এই উৎসব। রাতে বোলানের গান শুনতে শুনতে ঘুমে ঢুলে পরেন কাকা। তবু মন্ডপতলার গানের আসরেই সারা রাত বসে থাকেন। তার সঙ্গে প্রচুর ছেলে, মেয়ে, আপামর শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই ওই আনন্দ আসরেই রাত কাটান। সমস্ত দলাদলি, ঝগড়ার হিসেব নিকেশ হয়ে যায় এইরাতেই,বলতেন কাকা। এই আকর্ষণ ছেড়ে অন্য কোথাও যায় না গ্রামের মানুষ। কাকার বাড়ির শহরের এক কুটুম এই কাহিনী শুনে আনন্দিত। কাকা বললেন, নতুন কুটুম গো,তোমাকে বলছি,আমাদের এখানে এসে একবার গাজন দেখে যেও। খুব ভালো লাগবে।
অনেক গ্রামবাসী মদনকাকার আশেপাশে বসে পড়েছে,গল্প শোনার জন্যে। কাকা গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে অনেক ভালো ভালো উপদেশমূলক কৌতুক কথাও বলে থাকেন। মুড তার সব সময়েই ভালো। কথায় কথায় বলেন, পেটে ক্ষিদে নিয়ে কিছু হয় না। ধর্ম, শিক্ষা, কাব্য,গল্প কিস্সু হয় না। নবীন বললো,ঠিক বলেছেন কাকা।আগে পেট তারপরে অন্যকিছু।
— না না আপনি এড়িয়ে যেচেন। বলুন কেনে।
— শুধু জানলেই হবে না। বাস্তবে,কাজে, কম্মে ব্যবহার দিয়ে দেখিয়ে দাও দিকিনি বাছা। তবেই বলবো বাহাদুর বাবা। খুবএকটা সহজ নয় বাবা।
আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে কাকা সবাইকে বললেন,তাহলে কি হলো ব্যাপারটা।আগের কথায় ফিরে যাই। ম্যান মেড ফ্ল্যাড। আর নয়, আধুনিক কবিতার মতো বাকিটা বুঝে নাও। বলো, জয় সাধুবাবা।সবাই বললো, জয় সাধুবাবা।
মানুষ মরছে বানে।আর উনি জয় সাধুবাবা বলে পাড়া মাত করছেন।আপন মনে বললো, পাড়ার শিবু কায়েত।শিবু কায়েত শিবে বলেই পরিচিত।
হঠাৎ কুটুম জনা বলে উঠলেন,দেখুন, ওই গোরের ঘাটে কে বসে । কাকা বললেন, তুমি জানো না কিন্তু আর সবাই জানে। ও হলো মানে মাল। ওকে শিবে, বলেই পাড়ার লোকে ডাকে। বুদ্ধি খুব। কথায় বলে না, কায়েতি কায়দা। বোঝে রসের রসিক। তুমি আমি ছারপোকা। বললেন মদন কাকা। ছোটো থেকেই চালাকি বুদ্ধি ছিলো তার অসম্ভব। লাষ্ট বেন্চের ছেলে। বড়োদের সম্মান করতো না।
তাদের সামনেই সিগারেট ফুঁকে বাহাদুরি দেখাতো শিবে। বাবা, মা বড়ো আশা করে তাকে স্কুল পাঠান। কিন্তু স্কুলে র নাম করে সে মানুষকে জ্বালাতন করতো দিন রাত। তার জ্বালায় সকলেই বিরক্ত। এমনি করেই সে বয়সে বড়ো হলো। তার বাবা, মা একে একে মরে গেলো। এখন সে একা। তবু তার স্বভাব পাল্টালো না।
মদন কাকা বানের পরে ক্ষতিপূরণবাবদ কিছু টাকা পেয়েছলেন। গ্রামের সকলেই পেয়েছিলেন।সেই টাকাতেই সকলের বছরটা চলেছিলো। নীচুএলাকা বলে খরার চাষটা এখানে ভালোই হয়।আর বর্ষাকালে ভরসা নাই। অজয়ের গাবায় চলে যায় বর্ষার ফসল। সেইজন্যে অনেকে নামলা করে চাষ দেয়। আর তাহলে কিছু ধান ঘরে ঢোকে। যতই বান বন্যা হোক চেষ্টাতো করতেই হবে। কঁথায় বলে, আশায় বাঁচে চাষা। মনে মনে কত স্বপ্ন,গাথা। জমি ফেলে রাখলে বাঁজা হয়ে যাবে। তাই গ্রামের কোনো মানুষ হাল ছাড়ে না সহজে।
কাকা গ্রামে সকালবেলা হাঁটতে বেড়োন। আর সকলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে কথা বলেন। কাকা হঠাৎ সকালে একদিন গ্রামে চুল দাড়ি ওয়ালাএক সাধুবাবাকে ষষ্টিতলার বোল গাছের নীচে তার আসন পাততে দেখলেন। সাধুকে সকলেই বিশ্বাস ক’রে চালটা, কলাটাএনে তার ঝুলি ভরলেন। খাবার সময় হলে খাবার পেয়ে যান। কোনো অসুবিধা তার হয় না।
আর সাধুবাবা গ্রাম ছাড়েন না। কাকার সন্দেহ হয়। খুব চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু স্থিতধি মানুষ তো। তাই ভাবেন পরিবর্তনশীল এই জগতে অসম্ভব কিছু নয়। শুভ হোক সকলের। এই কথাই সকলের জন্য বলতেন। তাই বেশ খুশি মনে মদনকাকা বিকেল হলেইএকবার সাধুবাবার কাছে আসতেন।
বসে নিজে কথা বলতেন আবার সাধুবাবার কথাও শুনতেন। কাকা শুধু ধর্মের কথা নয় অন্য কথাও বলেন। ভন্ডামি তার অসহ্য। কাকা বলছেন বর্ডারগুলো একেবারে কি যে হয়েছে। বলে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। গরু পাচার, মানুষ পাচার, রত্ন পাচার কোনো আইন বা কাঁটতার আটকাতে পারছে কি? কোটি টাকার প্রশ্ন হে। সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে কোন ভূত দেশ ছাড়বে বলো। খুব চিন্তায় তিনি। সাধুবাবা বললেন, জয় জয় জয়। কাকা বললেন কার জয়। সাধুবাবা ওইটুকু বলেন। বাকি কথা বুঝে নেয় মানুষ।
সাধুবাবা জোরে হাঁক দিলেন, জয় জয় জয়। মানে কাউকে ডাকছেন।
সাধুবাবা দুর্বল চরিত্রের মানুষ নির্বাচন করেন প্রথমে । তারপর তাকে দিয়ে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নেন। একদিন ডোমপাড়ার বিজয় ওরফে বেজা এসে সাধুবাবার চরণতলে পরলো। সাধুবাবা বললেন, বল্ কি বিপদ তোর। বেজা বললো, বাবা অনেক চেষ্টা করেও সন্তান হলো না। বাবা বললেন,তোর চেষ্টায় ত্রুটি আছে। তারপর হাজার রকমের কাজ দিয়ে বেজার মগজ বোঝাই করে দিলেন। বনে যাবি।উলঙ্গ হয়ে প্রতি শনিবার জবা ফুলের কুঁড়ি খাবি। জলে গোবোর গুলে খাবি। স্ত্রীর মুখদর্শন করবি না ছয়মাস। তারপর একবছর পরে দেখবি ঘর আলো করে আসবে আনন্দের ফেরিওয়ালা। তোর বংশের প্রদীপ। তবে হ্যাঁ, আর একটা কঠিন কাজ আছে। করতে পারবি।
তারপর থেকে বেজার বউ আসে রোজ রাতে। ভোর হলেই চলে যায় ক্ষেতে। গ্রামের লোক ভাবে, জমিতে কাজ করে।
একবার মেয়েদের ভয় ভেঙ্গে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো সাধু। তারপরের পথ কুসুমাস্তীর্ণ।
মদন কাকা আর আশ্রমে আসেন না। কানাঘুষোয় অনেক কথা শুনেছেন। তাই নিজের মধ্যেই নিজেকে নীরবতার আড়ালে ঢেকে রাখেন।
আর এদিকে সাধু একের পর এক শিষ্য বাড়িয়ে চলে আর তেষ্টা মেটায় নশ্বর শরীরের। কিন্তু নিজের সমাধির গর্ত অজান্তে কেটেই চলে।
অবিনশ্বর আত্মার কথা কেন কেউ শোনে না।
আকাশে বাতাসে দীর্ঘনিশ্বাসের মেঘছায়া নীরবে সত্যের দামামা বাজিয়ে চলে অবিরত। মানুষকুল শুনেও শোনে না কানে।
বিজয় গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলো। তারপর আবার তপশিলী। পুলিশের চাকরী একটা পেয়েছে বছর পাঁচেক হলো।
বেজার বৌ কিন্তু ভোলেনি বেইমানকে।একদিন ডেঙা পাড়ার মাম্পি, বেজার বৌকে বললো,সাধু আমার ইজ্জত লিয়েছে। চড়াম করে রাগ হয়ে গেলো বেজার বৌ এর। এর আগে বিধবা বৌ ওআরও অনেকে রিপোর্ট করেছে বেজার বৌকে। ওদের গ্রামে মেয়েরা মেয়েদের কাছে সমস্ত কথা শেয়ার করে। বেজার বৌ বললো, তু বাড়ি যা। আমি দেকচি…
মদন কাকা বললেন, তুমি এখন আমাদের নও শিবু। তুমি এখন আইনের হাতে অপরাধি শিবু।
থানায় আজ রাতে কালীপুজো। বারবার বলা সত্ত্বেও বেজার বৌ থানায় আসে নি। সব পুলিশ অফিসারকে নিজের বৌ
খুন করার পরেই রক্তমাখা হেঁসো নিয়ে বিজয়ের বৌ থানায় এসে হাজির। সেএসেই বললো, আমি সাধুকে খুন করেছি। পাড়ার মেয়ে বৌ সকলে খবর পেয়ে থানায় এসে হাজির। সবাই সাধুর নামে ধর্ষণের অভিযোগ করলো। অফিসার গ্রেপ্তার করলেন বিজয়ের স্ত্রীকে। তারপর বললেন, যা হবে কোর্টে হবে। আপনারা সাক্ষী হিসাবে সকলে যাবেন।
মদন কাকা বলছেন,এই কেসে কিছু হবে না রে। ধর্ষকের কোনো মতেই বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তবে নিজের হাতে আইন তুলে নিবি না। আইনে ভরসা রাখবি। তার হাত অনেক লম্বা। কিছু উঠতি ছেলে বলে উঠলো, শালাকে খুন করে ভালোই করেছে বেজার বৌ। কাকা বললেন, ঠিক বলেছো। কাল আমরা সকলেই কোর্টে যাবো, বুঝলে হে। সবাই রাজি হলো। কয়েক মাসের মধ্যেই শোনা গেলো বেজার বৌ এর দুবছরের জেল হয়েছে। কাকা বললেন, যারা অপরের জন্যে জীবনের বাজি রাখে, সমাজকে সুস্থ রাখে তারাই হলো প্রকৃত সাধু।
কাকা সবাইকে বলছেন, ওদের জন্যে আমরা প্রার্থনা করি এসো। একটা সন্তান ওদের ঘর আলো করে আসুক। আর তাছাড়া আমাকে বলেছে,বিজয় শহরে বৌমাকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছিলো। ডাক্তারবাবু আশ্বাস দিয়ছেন। ওষুধও প্রয়োজন মতো দিয়েছেন। স্বামী, স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কের সাথে সাথে ওষুধ খাবার পরামর্শ দিয়েছেন। কোনো সিষ্ট বা অস্বাভাবিক ত্রুটি কিছুই নেই। আল্টাসনোগ্রাফি করিয়েছে শহরের ভালো ডাক্তারের কাছে। বিখ্যাত ডাক্তার আর, এন, মন্ডল বলেছেন, চার বছরের মধ্যেই সন্তান হবে। এর অন্যথা হবে না। কাকা বলেন, ডাক্তার হচে মর্ত্যের ভগবান। তারা যা বলেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাই হয়।
জেলে থাকলেও বিজয় ডাক্তারের ওষুধ দিয়ে আসতো প্রতি মাসে। নিজেও খেতো। দেখতে দেখতে দুবছর পার হয়ে গেলো।
আবার জীবনচক্র চলতে লাগলো। এবার বিজয় তার বৌকে আর মাঠে কাজ করতে যেতে দেয় না। শুধু অফিস যাওয়ার সময় রান্না করতো। আর সারাদিন সে পাড়ার কার কি সুবিধা অসুবিধা দেখতোআর তার সমাধান করে দিতো চট্জলদি।পাড়ার সব মহিলা একসাথে টাকা জোগাড় করে বিজয়ের বৌকে একটা সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছে।
গরীবলোকের অকৃত্রিম ভালোবাসা। তার স্বামী এখন চাকরী পেয়েছে। সরকারি পুলিশের চাকরি। তাদের এখন ধনী বলা যায়। কিন্তু বেজার বৌ মাম্পিদের বলে, খেপেছিস, আমি কি বসে থাকতে পারি। যতই বলুক তোর দাদা, আমি মাটি আর গোবরের স্পর্শ ভুলতে পারবো না। আমি যতদিন বাঁচবো, এই মাটি ছুঁয়েই থাকবো। এই বলে সে উঠোনের একমুঠো মাটি মাথায় বুলিয়ে নেয়।
বড়দা গল্প বলে চোখ মুছলেন। তারপর আবার শুরু করলেন কাকার বাকি জীবনের কাহিনী। মদন কাকাকে বড়দা নিজের আত্মীয় মনে করতেন। তাই নিজের জীবনের কথা তাকে বলতেন। আজও বলছেন,বাবার চাকরীসূত্রে লিলুয়া শহরে জীবনের তিরিশ বছর কেটেছে। কেতুগ্রাম থানার বড় পুরুলিয়া গ্রামে আমার চোদ্দ পুরুষের ভিটে। আমরা তিন ভাই মামার বাড়িতে জন্মেছি। আর ছোটো ভাই পুরুলেতে জন্ম গ্রহণ করেছে। তাই জন্মস্থান আমার আহমদপুরে নেমে জুঁইতা গ্রামে।
বাবা আমাদের তিন ভাইকে ও মাকে নিয়ে লিলুয়া এলেন। আমরা বিদ্যুতের আলো দেখিনি। লিলুয়া গিয়ে হঠাৎ বিদ্যুতের আলো দেখে চমকে গেলাম। কোথা থেকে এত আলো এলো। আমাদের চোখ ঝলসে যাওয়ার অবস্থা। মা আমাদের বললেন,একে ইলেকট্রিক আলো বলে
এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই।
মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। মেজভাই রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে।
গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন।
তাই আজও বৃদ্ধ বয়সে তুমি আমার খোঁজ নাও।
বড়দা জানতেন,মদন কাকা বিয়ে করেন নি। আজীবন অকৃতদার। মানুষের মঙ্গল চিন্তাই তার ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা। ভন্ডামি ছিলো না কোনোদিন। গেরুয়া রঙের হৃদয় আর সাদা বিশ্বাসে ভর করে মানুষের মাঝেই তার ঈশ্বর দর্শন। শেষ বয়সে আশেপাশের গ্রামে চাঁদা তুলে একটি লঙ্গরখানা বানিয়েছেন। সেখানে অনেক অভুক্ত মানুষ দুমুঠো খেয়ে দুহাতে প্রণাম করে সিদ্ধপুরুষ মদন কাকাকে।
জীবন ভাবে, মানুষ যা ভাবে তা হয় না কোনোদিন। তাদের বিয়ে হয় নি। মেয়েটা আর বিয়ে করে নি। সে এখন নামকরা কলগার্ল। সে হতে চেয়েছিল ঘরণী। একটা ঘর আর একটা সন্তান আর স্বামী। সবাই সব কিছু পায় না। জীবন এক রঙ্গমঞ্চ। অভিনয় করে যাই আমরা দিবারাতি। এক অদৃশ্য সুতোর টানে চলছে এই পুতুলখেলা। কিন্তু বিশুর মনের বয়স বাড়ে নি আমাদের মতো। কোনো বাচ্চাকে রাস্তায় দেখলে কোলে তুলে আদর করা, কুকুর ছানা দেখলে কোলে নেওয়া এখনও তার প্রিয় সখ। তার স্পর্শে সেজন ধন্য হয়ে যেতো।
বিশু এখন দু একটা গান লেখে। আবার নিজের কন্ঠে গায়। তার গাওয়া গানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। আমি, বিশু, জীবন মধ্যবয়সে কাটোয়া স্টেশনে এসে বসি সন্ধ্যাবেলায়। পুরোনোদিনের স্মৃতি রোমন্থন করি বারেবারে। আমরা তিনজনেই কাটোয়া শহরে বাড়ি তৈরি করে আছি। বিশু বিয়ে থা করেনি। একা কাটায় জীবন আর আমরা আছি ওর সঙ্গে। বিশুর সার্থক মানুষ জন্ম। পরের উপকার করতে তার ভালো লাগে। এখনও স্টেশনের চালচুলোহীন মানুষের সেবা করার জন্য একটা সেবাদল তৈরি করেছে। জীবনের শেষ সম্বলটুকু মানে বাড়িটাও একদিন বিক্রি করে দিল সেবাদল চালানোর জন্য। আমরা সবাই মানুষ। কিন্তু বিশুর মত মানুষ জন্ম কজনের হয়।
বাবা-মা এখন আর নেই। তারা চলে গেছেন জমি-বাড়ি জায়গা ছেলেমেয়ে সব ছেড়ে। ওপারের ডাকে অচিনপুরে কেউ জানেনা কোথায় তারা। আর ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা চিন্তা করেন না তারা বেশ সুখে শান্তিতে আছেন। এই ভাবেই জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে জীবন প্রবাহ চলতেই থাকে কোনদিন থামেনা।
এখন আমি বিশু,বিরাজুল, রমেন আরো অনেকে রেলওয়ে প্লাটফর্মে বসে থাকি। আর কখন যাবার ডাক আসবে কেউ জানেনা। শুধু অপেক্ষা প্রতীক্ষা ট্রেনের ট্রেনে চেপে পড়তে হবে তারপর ট্রেন চলে যাবে অচিনপুরে। মনে পড়ে আমাদের ছোটোবেলার কথা। কিন্তু একদিন তো চিতায় বা কবরে যেতে হবে। বিরাজুল বলত, মাটি হল শেষকথা গো। মাটি, খাঁটি।
বিশু মাঝে মাঝে খোলা মাঠে আকাশের নিচে থাকতে ভালোবাসে। হাতে নিয়ে এসে একদিন বেশ দুম করে চলে গেল অজয় নদের ধারে। বিশু ভরা বর্ষার অজয়ে নেমে পড়ল। জলে সাঁতার কাটতে কাটতে ওপারে চলল।আমি কিছু বোঝার আগেই সেজন্য জলে নেমে পড়ল আমি চিৎকার করে ডাকলাম বিশু, ভরা বর্ষার জলে তুই যাস না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সে সাঁতার কাটতে কাটতে চললো ওপারের আশায় । আমি অবাক হয়ে দেখলাম অজয়ের গভীর জলের স্রোত বিশুর মাথার উপর দিয়ে বড় বড় ঢেউ হয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে। একটার পর একটা। ঢেউ যেন শেষ হতে চায় না। একটার পর একটা ঢেউ বিশুকে ঢেকে ফেলল। আর দেখা গেল না।
আমি একা একা বিষন্ন হৃদয়ে ফিরে এলাম দুদিনের বাঁধা ঘরে। আমি ভাবলাম বিশু ঢেউ হতে পারে, আমি কেন পারি না। জানি এ আফসোস বেশিদিনের নয়,আমাদের আড্ডার আসরে, আজান আলপনার মাঠে একজন আড্ডাবাজের নাম প্রকৃতির নিয়মে মুছে গেল চিরতরে। এবার পালা বদলানোর পালার প্রতীক্ষা।
#storyandarticle

Post a Comment