"কবিতা আজ ব্রাত্য-কেন?" সুমিত রঞ্জন সাহা

 

storyandarticle


প্রযুক্তিনির্ভর, প্রতিযোগিতা সর্বস্ব দ্রুতগতির এই যুগে মানুষের জীবন আজ অনেক বেশি জটিল। মানুষের হাতে অবসর ও কম, পাশাপাশি -বিনোদনের নানাবিধ আয়োজন ও আজ হাতের মুঠোয়। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বহুল প্রসারের ফলে ঘরে ঘরে আজ 'কেবল টিভি' বা 'ডিশ এন্টেনার 'সংযোগ। কম্পিউটারের মাধ্যমে ও রয়েছে মনোরঞ্জনের অনেক সুযোগ। 

একটা বোতাম টিপলেই রয়েছে নাচ, গান, চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক অথবা ভিডিও গেমস বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে নানা চটকদার আকর্ষণ। সঙ্গে রয়েছে 'রিয়েলিটি শো ' এবং আরো অনেক কিছু। মনোরঞ্জনের এইরকম 'রেডিমেড ' চিত্তাকর্ষক হাতছানি উপেক্ষা করে ধৈর্য ধরে গল্প- উপন্যাস- কবিতা পড়ার মতো সময় ও ইচ্ছা খুব কম মানুষেরই আছে।

আধুনিক যুগে মহাকাব্য লেখা হয়না,তার প্রধান কারণ -পাঠকের অভাব। মহাকাব্য পড়ার মতো সময় ও ধৈর্য এ যুগের পাঠকের নেই বললেই হয়।উপন্যাস, বড় গল্প বা প্রবন্ধ পড়ার মতো পাঠকের সংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান। তুলনায় ছোট গল্প পড়ার পাঠক হয়তো একটু বেশি। তাও খুব যে বেশি - তা নয়।

 আসলে চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন এর মাধ্যমে মনোরঞ্জন এ যারা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন -সেই সকল মানুষেরা, বেশিরভাগ সময়ই আর বই পড়ে সাহিত্যের রস আস্বাদন করার মতো কষ্ট টুকু আর করতে চান না। গল্প বা উপন্যাস যখন চলচ্চিত্র বা ধারাবাহিকের কাহিনী হয়ে উপস্থাপিত হয় তখন ঘুরপথে সেই সাহিত্যের রস খানিকটা প্রাপ্ত হন তারা। পাঠকের চেয়ে দর্শকের সংখ্যায় বর্তমানে অনেক বেশি। 

কিন্তু কোন সাহিত্য- সৃষ্টি নিজে পড়ে হৃদয়াঙ্গম করলে যে উপলব্ধি হয়, যে স্বাদ পাওয়া যায় - অন্যের প্রদর্শিত পথে তা কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়,পাঠক মাত্রই তা জানেন। যাই হোক, পাঠক সংখ্যার নিরিখে সবচেয়ে দুরবস্থা কবিতার। বর্তমানে খুব কম মানুষই কবিতা পড়েন। অথচ শুরু থেকেই সাহিত্যের আত্মপ্রকাশ কাব্যের মাধ্যমেই।সাহিত্যে গদ্যের প্রবেশ অনেক পরে।

 বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কবিতা আকারে খুব বেশি বড় হয় না। তাই কবিতা পড়ার জন্য খুব বেশি সময় ও ধৈর্যের প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়।যে কারণে ছোটগল্প এখনো অনেকের মধ্যেই জনপ্রিয়,সেই কারনেই কবিতা ও অনেক বেশি জনপ্রিয় হতে পারতো মানুষের মধ্যে। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটি বিপরীত। সাহিত্য পাঠের প্রতি বেশিরভাগ মানুষের অনীহার কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে তা বাদেও কবিতার ক্ষেত্রে পৃথক আরো দু-একটি কারণ আছে বলে মনে হয়।


ছন্দের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক সেই জন্ম লগ্ন থেকেই। কবিতায় ছন্দের দোলা পাঠকের মন কে আকৃষ্ট করে,পাঠকের মনোযোগ কে ধরে রাখতে সাহায্য করে। বর্তমানের কবিতা গুলিতে ছন্দের প্রয়োগ খুব কম ই পরিলক্ষিত হয়। অন্তমিল যুক্ত অথবা ছন্দ মেলানো কবিতা খুব কমই লেখা হয়। গদ্য কবিতা তে ছন্দ থাকলেও সকলের পক্ষে তা অনুধাবনযোগ্য হয় না। বহু আধুনিক কবিতায় ছন্দের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। কবিতায় ছন্দের অভাব কবিতার প্রতি পাঠকের আকর্ষণ হ্রাসের একটি কারণ। 

অন্যদিকে কবিতাতে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনায় কিছুটা আড়াল -আবডাল বা খানিকটা হেঁয়ালি অনেক পুরনো পদ্ধতি। কবিতায় আলো-আঁধারির খেলা অনেক সময় কবিতার আকর্ষণ বাড়ায়। বিষয়বস্তুকে কুয়াশাবৃত করে রাখা, অব্যক্ত কিছু কথা বা রহস্যময়তা বর্তমানে আধুনিক কবিতার একটি ধারার বৈশিষ্ট্য,যা নিঃসন্দেহে পাঠককে আকৃষ্ট করে। কিন্তু সজাগ থাকতে হবে যে কবিতা যেন দুর্বোধ্য না হয়ে ওঠে। অনেক বিদগ্ধ সমালোচকদের মতে - আধুনিকতার নাম করে বহু কবি-ই কবিতা কে অনাবশ্যক জটিল ও দুর্বোধ্য করে তোলেন, যার মর্মোদ্ধার করা অনেক পাঠকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠেনা।

 ফলে পাঠক কবিতার রস আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হয়ে আকর্ষণ হারান কবিতা পাঠের।এই ঘটনা বারবার ঘটলে পরবর্তীকালে পাঠক আর কবিতা পাঠের তাগিদ অনুভব করেন না।বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য থেকে দুর্বোধ্য তর হয়েছে। পাঠক সমাজ ও একটু একটু করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন কবিতার দিক থেকে। অবশ্য সব আধুনিক কবিতাই জটিল বা দুর্বোধ্য নয়। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ পাঠকই কবিতা দেখলে তা সযত্নে এড়িয়ে যান। পড়ে দেখার চেষ্টা টুকু-ও করেন না।


কোন কোন কবি অবশ্য মনে করেন যে- কবিতা সকলের জন্য নয়।তাদের কবিতা কেউ পড়ল কিনা বা বুঝলো কিনা সে বিষয়ে তারা হয়তো চিন্তিত নন। নিজেদের একটি গণ্ডি তৈরি করে তারা নিজেদেরই তাতে আবদ্ধ করে ফেলেছেন,বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন সাধারণ পাঠকের কাছ থেকে। কোন সাহিত্য সৃষ্টি পাঠকের কাছে না পৌছালে বা সমাদ্রিত না হলে তা পূর্ণতা পায় না -বলেই আমার মনে হয়। 

কবিদের প্রতি আমার বিনম্র অনুরোধ -আরও একবার ভেবে দেখুন, কবিতাকে অনাবশ্যক জটিল ও দুর্বোধ্য করে তুলবেন না। এখনো সজাগ না হলে ভবিষ্যতে কবিতা হয়তো সাহিত্যের একটি লুপ্তপ্রায় শাখায় পর্যবসিত হবে।


#storyandarticle