শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য: "THE WESTLAND" টমাস স্টার্নস এলিয়ট ---- একটি যুগের নাম (২৬/০৯/১৮৮৮ - ০৪/০১/১৯৬৫)
সৌম্য ঘোষ
"In my beginning is my end"--
সেন্ট লুই মিসুরিতে জন্মেছিলেন এক বিরল মনোজ্ঞ দার্শনিক কবি। আবেগ নয় প্রখর বুদ্ধিমত্তা যার কবিতার শেষ কথা। ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তারও আগে ১৮৩৪ সালে এলিয়টের পরিবার চলে আসেন সেন্ট লুইসে। পিতা হেনরি ওয়্যার এলিয়ট ছিলেন হাইড্রলিক্স প্রেস ব্রিক কোম্পানির প্রধান। মা শার্লট ছিলেন কবি ও সমাজকর্মী।
তরুণ এলিয়ট স্মিথ অ্যাকাডেমিতে গ্রীক, লাতিন, ফরাসি আর জার্মান শিখে দর্শন পড়তে চলে এলেন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯১৪ সালে ২৫ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডে চলে আসেন। ১৯২৭ সালে ৩৯ বছর বয়সে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নেন। যেহেতু তিনি ছিলেন উচ্চবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। তাই ধর্মীয় চেতনা,এই ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন কবির অবচেতনে প্রোথিত হয়েছিল অজান্তেই। তাঁর পরম সত্যের খোঁজ চলেছে দেশকাল ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে, কবিতা হতে কবিতা পেরিয়ে সারা বিশ্বের কবি এবং সৃষ্টিশীল মানুষের মননে মনোজ্ঞ ছায়াপাত করে।
সুইনবার্ন আর টেনিসনের অনুসরণে এক ধরনের রক্তহীন, শিক্ষানবিশী কবিতা মকশো করেন তিনি। তার পর একদিন হঠাৎ কী ঘটে গেল, হাভার্ড ইউনিয়ন লাইব্রেরিতে সদ্য কেনা আর্থার সাইমন্স এর ''The symbolic movement in Literature" এর পাতা ওল্টাতে গিয়ে এক বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে গেল তাঁর মেরুদণ্ড দিয়ে। এলিয়টের ভাষায়, "It affected the course of my life"। ঊনিশ শতকের শেষ দিকের ফরাসী প্রতিকবাদী কবিদের, বিশেষত জ্যুল লাফর্গ নামে এক সাতাশ বছর বয়সে মৃত কবির কবিতার নমুনা পড়ে কুড়ি বছর বয়সী এলিয়টের চোয়াল শক্ত হল। তিনি বুঝতে পারলেন নতুন সময়ের কবিতা আর আগের মতো হবে না। জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন পুরনো কবিতার বয়ান ছিঁড়ে আবর্জনা স্তূপে নিক্ষেপ করলেন তিনি।
শহুরে জীবনের মালিন্য আর শূন্যতাকে নিয়ে ভাঙাচোরা এক শ্লেষদীর্ণ ন্যারেটিভ হাতে কবিতার জগতে প্রবেশ করলেন তিনি। সেই কবিতার নাম 'প্রিলিউডস'। বস্টনের মফসসলকে নিয়ে দুটি অংশ লেখার পর (" The winter evening settles down / with smell of steaks in passage ways") প্যারিসে চলে গেলেন তিনি, তীর্থ দর্শনের জন্য এই তীর্থযাত্রা তাঁর প্রয়োজন ছিল, বারুদ সংগ্রহের জন্য ইতিহাসের এক ব্রাহ্মমুহূর্তে, আঙ্গিকের এক নতুন ঠিকানা প্রয়োজন ছিল তাঁর।
আঁরি বের্গসনের একটি বক্তৃতায় জানা যায় , ঔপন্যাসিক আল্যাঁ ফুর্নিয়ে ও বোডিং এর প্রতিবেশী জাঁ ভেরদ্যনালের (যে প্রয়াত বন্ধুকে ১৯১৭ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই 'পরুফ্রক অ্যান্ড আদার অবজারভেশন্স' উৎসর্গ করেন তিনি এবং যে উৎসর্গপত্রে সমকামিতার ইঙ্গিত ছিল) সঙ্গে লাফর্গের কবিতাপাঠ তাকে প্রস্তুত করলো বিস্তারে যাওয়ার জন্য। ১৯১১ থেকে ১৯১৪ আবার হাভার্ড।
মাসাচুসেটসের মিলটন অ্যাকাডেমি থেকে স্নাতক হওয়ার পর এই প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ কবি পাড়ি দেন হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপরই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, এবং একের পর এক কালজয়ী কাব্যগ্রন্থের জন্ম। ভাবতে অবাক লাগে যুদ্ধের ভয়াবহতা যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে এই কবির কলমের গভীরতা। এলিয়টকে খুঁজে পেয়েছিলেন এজরা পাউন্ড। 'দ্য লাভ সংগস অফ জে আলফ্রেড পরুফ্রক' যখন পাউন্ডের হাতে পৌঁছয়, জহুরী পাউন্ডের 'টমাস এলিয়ট'কে চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি৷ ইউরোপ এবং আমেরিকা সাহিত্য আঙিনায় বিখ্যাত জহুরী ক্রিটিক বা সমালোচক পাউন্ড সাক্ষাৎ কষ্টি পাথর, সোনা চিনে নিতে তাঁর অসুবিধে হত না। 'Poetry' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সাড়া জাগানো কবিতা সংকলন 'লাভ সংগস অফ জে আলফ্রেড পরুফ্রক।' প্রশংসায় পঞ্চমুখ পাউন্ড বলেন ''টমাস নিজেকে আধুনিক শুধু করেনি, নিজেকে কঠোর মানসিক অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছেন। বেশিরভাগ কবি এ দুটির একটি করে থাকেন। বা কেউ কেউ কোনটাই করেন না।"
'দ্য সং অফ জে আলফ্রেড পরুফ্রকে'ই দেখা যায় কবির অন্য এক ইগো। " Let us go then You and I' কবি ডেকে নেন তাঁর অন্তরের সাথী পরুফ্রককে। দুজনে ঘুরে বেড়ান পথে পথে। চেতনা ধাক্কা খায় হলুদ কুয়াশা মোড়া লন্ডনের জানালার শার্শিতে। এই নগরীর পথে পথে চিমনির কালির বিষণ্ণতা মাখানো। যেখানে মানুষ মুখোশ পরে আরও কিছু মুখোশ মোড়া মুখের সম্মুখীন হতে। 'টু প্রেপেয়ার আ ফেস ফোর দ্য ফেসেস আই মিট'। এক অনুর্বর ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে কিছু মহিলা, যারা উর্বর ভাস্কর মাইকেল এঞ্জেলোর ভাস্কর্যের আলোচনা করতে করতে। "উমেন কাম এন্ড গো টকিং অফ মাইকেল এঞ্জেলো।"
এভাবেই ঘোরে তারা মহানগরীর পথে পথে। এই বিষণ্ণ লন্ডন নগরীতে মানুষ নিজেদের জীবন মাপছেন কফির চামচের ক্ষুদ্র পরিসরে। 'আই হ্যাভ মেসারড আউট মাই লাইফ ইন কফি স্পুন্স।' শেষ ছত্রে কবি বলেন 'টিল হিউম্যান ভয়সেস অয়েক আস, এন্ড উই ড্রাউন।" অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন এই কবি। এনেছিলেন নতুন জোয়ার প্রতীকে, চিত্রকল্পে, শব্দে, রঙের ব্যবহারের দুনিয়াতে। এই বিশ্ব এক বিশাল 'ওয়েস্টল্যানড'। যে বিশ্ব যুদ্ধে জর্জরিত, চিন্তায় অক্ষম, কর্ষণে, মানসিক পরিশ্রমে অপারগ। এক বিশাল বন্ধ্যা জমি এই সমাজ এবং সমাজে বসবাসকারী মানুষ। এই ছিল কবির কবিতার অনবদ্য যুগান্তকারী ছবি।
এলিয়ট বলেন, তার বিখ্যাত রচনা 'ট্রাডিশন এন্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট' এ "পোয়েট্রি ইস নট এ টারনিং লুস অফ ইমোসন। বাট ইট ইস অ্যান এস্কেপ ফ্রম ইমোশন। পোয়েট্রি ইস নট অ্যান এক্সপ্রেশন অফ পার্সোনালিটি, ব্যাট অ্যান এস্কেপ ফ্রম পার্সোনালিটি। দোস হু হ্যাভ পারসোনালিটি অ্যান্ড ইমোশন নোজ, হোয়াট ইট মিন্স টু ট্রাই টু এস্কেপ ফ্রম দিস থিংস।"
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু প্রথমে তীব্র নিন্দা করতেন এলিয়টের কবিতার। তাঁর 'আনট হেলেন'(Anat Hellen) এবং 'প্রিলিউড'(The Preleud) কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে সে কথা লিখেছিলেন। পরবর্তী কালে কবি বিষ্ণু দে কবির 'দ্য জার্নি অফ ম্যাজাই' অনুবাদ করেন এবং এলিয়টের নাম গোপন করে রবীন্দ্রনাথকে দেখান ছন্দ সংশোধনের জন্য। এবার রবীন্দ্রনাথ যারপরনাই মুগ্ধ হন। তখন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত 'আসল' কবির পরিচয় রবীন্দ্রনাথকে জানান। রবীন্দ্রনাথ নিজের কথা ফিরিয়ে নেন এবং 'তীর্থযাত্রী' নাম দিয়ে কবিতাটি অনুবাদ করেন। পরবর্তীকালে কবি বিষ্ণু দে এই কবিতাটির আরও পরিণত অনুবাদ করেন এবং নাম দেন 'রাজর্ষিদের যাত্রা'। রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেন এলিয়টের ছন্দ, প্রতীক, চিত্রকল্প, বাগধারার, ব্যবহার যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবক্ষয় আক্রান্ত সমাজ ও পৃথিবীর চিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তিনি না থাকলে ইংরেজি ও মার্কিন কবিতায় যে শূন্যতা তৈরি হতো, বাংলা সাহিত্যেও কি তার কোনও অংশে কম? অমিয় চক্রবর্তীর কাছে এলিয়টের কথা না শুনলে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কি কোনও দিন আসত মরা বেড়ালের ছানা, মাছের কানকো বা কাঁঠালের ভূতি-র মতো বাস্তব জীবনের ছবি? রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে 'দ্য জার্নি অফ দ্য ম্যাজাই' এর কথা বিষ্ণু দে-র একটি অনুবাদের পরিমার্জনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে নতুন কবিতা নির্মাণ করেছিলেন - কে ভুলবে? শুধু সমর সেন, বিষ্ণু দে বা সুধীন দত্তের নতুন কাব্যভাষা নয়, জীবনানন্দ দাশের অত্যাশ্চর্য বিনিমার্ণের আড়ালেও হয়তো কাজ করেছে টি.
এস. এলিয়টের কুঠার।
তাঁর জীবনের এক অজানা ছায়াময় দিক কয়েক বছর আগে উদ্ঘাটিত হয়েছিল ক্যারল সেমূর-জোন্স রচিত এলিয়টের প্রথম স্ত্রী ভিভিয়নের জীবনীতে। দ্বিতীয় স্ত্রী ভালেরি এলিয়টের (এলিয়টের মৃত্যুর পর যিনি কার্যত 'ফেবার অ্যান্ড ফেবার' প্রকাশনা সংস্থার অঘোষিত প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন)। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও বাধা অতিক্রম করে প্রকাশিত হয়েছে কবির চার খণ্ড চিঠিপত্র। এই কলকাতা থেকেই প্রকাশিত একটি বই ফরাসি কবিতার প্রতি এলিয়টের চমকপ্রদ ঋণ উদ্ঘাটিত করে সারা বিশ্বে এনেছিল শীতের কম্পন।
অশান্তিপূর্ণ দাম্পত্য জীবন, ভিভিয়নের অসুস্থতা, বাট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে ভিভিয়নের ঘনিষ্ঠতার দুঃস্বপ্ন এবং আর্থিক অনটন। লন্ডনে ও বাকিংহামশায়ারে স্কুলে পড়িয়েছেন তিনি, অর্থোপার্জনের জন্য পুস্তক সমালোচনা করেছেন, ১৯১৭ থেকে সাত বছর লয়েডস্ ব্যাঙ্কে কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁর ধারালো ছুরির মতো কবিতার অভিযান অব্যাহত থেকেছে।
কখনও লিখেছেন ঋজু গদ্যকবিতা, মুক্ত ছন্দ অথবা টানা গদ্যের কবিতা, যে কবিতা ছাপেননি (যেমন 'The mind was six feet deep in a cistern and a brown snake with a triangular head having swallowed his tail was struggling like two fists interlocked. His head slipped along the brick wall, scrapping at the cracks.") তা-ও সব পাশার দান উল্টে দিতে পারতো। কখনও তেওফিল গোতিয়ের চার পংক্তির শ্লেষাক্ত স্তবক নকল করছেন, কখনও দাম্পত্যজনিত স্নায়বিক বিপর্যয়ের মধ্যে লোজানের এক স্যানাটোরিয়ামে বসে নানা ধরনের কবিতার কোলাজ। যা কেটেছেটে এজরা পাউন্ড তৈরি করেন আধুনিক সভ্যতার মহাকাব্য 'দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড(The West land)-১৯২২।
দুটি রচনায় তাঁর বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ উঠে। এই সব কিছু ভুলতে তিনি হয়তো আমেরিকাবাসিনী এমিলি হেলের প্রেমপ্রার্থী ছিলেন৷ তিনি ১৯৪৮ সালে 'সাহিত্যে নোবেল' এবং 'অর্ডার অফ মেরিট' উপাধি পান। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার মধ্যে, 'দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড(The West Land), 'দ্য লাভ সং অফ জে.আলফ্রেড প্রুফক(The love Song of J. Alfred Prufock), 'দ্য হলো ম্যান(The Hollow men) ইত্যাদি। আর তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে, 'দ্য ককটেল পার্টি (The cocktail Party), 'দ্য ফেমিলি রিইউনিয়ন (The Family reunion)ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যেতে পারে, এই মনোজ্ঞ, দার্শনিক কবি তার প্রভাব বিস্তার করেছেন দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীর কবিদের বৌদ্ধিক জগতে, আবেগকে অতিক্রম করে। আবেগ আধুনিক যুগের কবিতায় যে অনুঘটকের কাজ করতে পারে না তা দেখিয়েছিলেন এই পণ্ডিতমনস্ক কবি। কবিতা যে জটিল এবং কঠোর কর্ষণযোগ্য হতে পারে তারই দীক্ষা সারা বিশ্বের সাহিত্যকে দিয়েছিলেন এই কবি। সাহিত্যকে বাঁধা যায় না দেশকালের সীমায়, তাই বাংলা সাহিত্য দু'হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছে এই কবির পাণ্ডিত্য।
লেখক •••• সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া। পশ্চিমবঙ্গ।
Post a Comment