বই রিভিউ
আত্মদর্শনের কবিতা

তৈমুর খান

জীবন একটা মহাকাল প্রবাহের সামান্য ড্যাশ মাত্র। এই ড্যাশ কেমন? একজন বিখ্যাত আমেরিকান সংগীতশিল্পী ও দার্শনিক কেভিন ওয়েলচ(১৯৫৫) বললেন:'There’ll be two dates on your tombstone and all your friends will read ’em but all that’s gonna matter is that little dash between ’em.' ~ Kevin Welch
অর্থাৎ আপনার সমাধির পাথরে দুটি তারিখ থাকবে এবং আপনার সমস্ত বন্ধুরা এগুলি পড়বে তবে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হ'ল তাদের মধ্যে সামান্য ড্যাশ।
এই দুটি তারিখ জন্মের ও মৃত্যুর আর তার মাঝখানে যে সামান্য ড্যাশ সেটুকুই জীবন। কথাটি মনে পড়ল আব্দুল বাসার খানের 'নীল ঝর্ণা হলুদ সাঁকো' (প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০২০) কাব্যগ্রন্থখানি হাতে নিয়েই। নীল ঝর্ণার পাশে জীবনের উৎসকে খুঁজে পেলাম। হলুদ সাঁকোর পাশে জীবনের সমাধিস্থ সমাপ্তি ঘোষণাকে উপলব্ধি করলাম।
গ্রন্থের 'প্রাসঙ্গিক: উঠান আলপনা'য় একথার স্পষ্টতা প্রতিধ্বনিত করেছেন। নীল ঝর্ণায় জেগে উঠেছে 'আমি' সত্তা= নিরন্তর সূর্য, অক্ষতল। অর্থাৎ পার্থিব জীবনের শরীর, যখন উপলব্ধি আর প্রবৃত্তির জাগরণে সমৃদ্ধ।
তারপর 'তবু' অব্যয় ব্যবহার করে অন্ধকারে গমন এবং শূন্যতার বুক—সম্মোহনে দীর্ঘপথের অন্বেষণ। কবি লিখেছেন: 'অন্ধকারও ছুঁয়েছে আমাকে/ শূন্য বুক, দীর্ঘ পথরেখা—'
তারপর একটি ক্রিয়া 'চলা' অর্থাৎ জীবনধারায় প্রবহমান হওয়া। কবি লিখেছেন: 'এই চলা'....
সবশেষে দুটি প্রশ্নসূচক শব্দ:
'কেন?' এবং 'কার ডাকে?'
এই দুটি শব্দের মাঝখানেই দিয়েছেন ড্যাশ।
এই ড্যাশেই জীবনের পরিমাপটুকু, চলাটুকু, বেঁচে থাকাটুকু থেকে যায়। যদিও জীবন নাথিংনেসেই সমর্পিত। কবি ব্যাখ্যা করে লিখেছেন... 'অন্তরালে ছুঁয়ে থাকা স্বপ্নবেলা। কোনো রঙ নেই, অথচ বিচিত্র বিস্ময়। আমি হেঁটে চলেছি, কোথাও পৌঁছাতে পারিনি।'
একটা তারিখ থেকে আরেকটা তারিখের দিকে হেঁটে যাওয়া যায়, কিন্তু পৌঁছানো যায় না। তাই কবিও পৌঁছাতে পারেননি, অথচ তিনি হেঁটে চলেছেন। তাঁর হাঁটার শেষ নেই। হাঁটতে হাঁটতেই দেখেছেন: ছাদহীন শূন্য মাঠ। নন্দিনীরা আঁচল ওড়াচ্ছে। চারু-নীলের ছায়া কপাট খুলে যাচ্ছে। একে একে ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। যদিও কিছুই ছিল না। তবু ভেসে যাচ্ছে। কবি জিজ্ঞেস করেছেন: কী ভেসে যাচ্ছে?
কবি উত্তর পেয়েছেন: মায়া ভেসে যাচ্ছে। যা শূন্যতারই অর্থাৎ এম্পটিনেসেরই প্রজ্ঞা। এইখানেই জীবনের শেষ তারিখটি স্তব্ধ হয়ে যায়। তাই কবি লিখেছেন:
'সুদূর পিয়াসী মন-পাখি
দৃশ্য শূন্যতার অনুভবে
এসো, সাঁকোটি পেরোই
পেরোতে পেরোতে নীলাভ সিক্ততায়
জীবন-আকাশ মাখি'
এই 'জীবন-আকাশ' অনন্তেরই উচ্চারণ ও বিকাশ। সম্পূর্ণরূপে নাথিংনেসে পৌঁছানোরই প্রাগভাষা। উপলব্ধির চূড়ান্ত রূপই অসীমতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে। এই কারণেই বিখ্যাত কবি উইলিয়াম ব্লেক(১৭৫৭-১৮২৭) বলেছেন:'If the doors of perception were cleansed every thing would appear to man as it is, Infinite. For man has closed himself up, till he sees all things thro' narrow chinks of his cavern.'
(William Blake, The Marriage of Heaven and Hell: In Full Color)
অর্থাৎ উপলব্ধির দ্বার শুদ্ধ হলে প্রতিটি জিনিসই মানুষের কাছে দেখা যেত, অসীম। কারণ মানুষ নিজেকে বন্ধ করে রেখেছে, যতক্ষণ না সে তার গুহার সরু চিকন দিয়ে সব কিছু দেখতে পায়। আব্দুল বাসার খানও সেই অসীমতায় পৌঁছতে পেরেছেন। প্রেম থেকে যাত্রা শুরু অর্থাৎ ছোট্ট ড্যাশ অতিক্রম করার প্রয়াস। তারপর সবই অনন্তের আকাশে সমর্পিত। কয়েক টুকরো কবিতার উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে:
'আকাশ চিঠির সব অক্ষর
এখনো রেখেছি জমা,
রাত্রি দুয়ার খুলে ফিরে এসো
প্রভাতের প্রিয়তমা।'
'আকাশ চিঠি' কথাটি ইঙ্গিতপূর্ণ অনন্তের প্রতীকী অভীপ্সা। আর যেখানে অন্ধকারের দরজায় প্রভাতের অপেক্ষা। এই প্রসঙ্গেই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সোরিন সেরিন(১৯৬৬) বলেছিলেন:'Only in the eyes of love you can find infinity.'
(Sorin Cerin, Wisdom Collection: The Book of Wisdom)
অর্থাৎ শুধু ভালোবাসার চোখেই তুমি অনন্ত খুঁজে পাবে। ভালোবাসা কখনো আশ্চর্য জাদুকর হয়ে উড়েছে কবিতাগুলিতে। তাদের সম্মোহনী ডানাও বিস্তার করেছে। ড্যাশের মধ্যেই অবস্থান করেই অনন্তের এই প্রাজ্ঞ দর্শনের বিক্রিয়া কবির মধ্যেও ঘটে চলেছে। তাই অন্য একটি কবিতায় লিখেছেন:
'সব কবরের ছায়া থেকে তুলে আনা প্রশ্নের
বৈদেহী উত্তরগুলো
যতই সুন্দর হোক
আমি আর কাফন গল্পের শুভ্রতা মাখবো না।'
অনন্ত কখনোই তার ক্ষুদ্রত্বকে গ্রহণ করে সীমানা নির্দেশ করে না। সর্বদা তা অসীমতায় পর্যবসিত হয়। আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার ফিলিপ কে ডিক(১৯২৮-১৯৮২) এই কারণেই বলেছিলেন:'The problem with introspection is that it has no end.'
(Philip K. Dick)
অর্থাৎ আত্মদর্শনের সমস্যা হল এর কোনো শেষ নেই। এই আত্মদর্শন কবির জীবন যাপনের মুহূর্তগুলোতে রূপান্তর ঘটে চলেছে। যে জনস্রোত তিনি দেখেছেন তা 'বুধনি বুড়ি' হোক, কিংবা চৈত্র আষাঢ় শ্রাবণ অথবা শীতকাল হোক, অথবা মধুর মায়ের গর্ভবতী গাভীর গল্প হোক, অথবা সুতপার শাশুড়ির ভারি বয়সের প্রেম হোক, কিংবা বাড়ির ছাদের বিকেল হোক—সবই অনন্তের কাছে ধ্বংস হয়ে যায়। হাতের তালুতে অনন্ত এসে বসত করে। মাটিও অনন্তের প্রচ্ছদ। আকাশ অনন্তের পৃষ্ঠা। নদী অনন্তের প্রবাহ। ঘামশরীর নোনাগন্ধ অনন্তের উপলব্ধি। কবিতায় সে কথাই বলেছেন বারবার:
'যা ঝরেছে অনিবার নীলিমা প্রশ্রয়ে
জুড়েছে হলুদ সাঁকো
সীমাহীন জাগরণ ছায়ে,
আমিও কালের খামে
প্রিয় অভীপ্সার নামে
নীল-ঘট একান্তে ভাসাই….'
সেই 'নীলিমা প্রশ্রয়' নীল ঝর্ণারই প্রকারান্তর, যাতে রোদের বহতা স্রোত মেখে কবি হেঁটে চলেন। তাঁর ড্যাশ তাঁকে নিয়ে চলে স্বপ্ন-মধুপুরের দিকে। জীবনরেখার অজস্র মোচড়ে তরঙ্গের ছায়া সিঁড়ি তাকে পৌঁছে দেয় অনন্তের মহা পৃথিবীতে। সেখানে কবির উপলব্ধি হয়:
'নাগালবিহীন ঊর্ধ্বলোক, নক্ষত্রকথা।' আত্মদর্শন চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। আব্দুল বাসার খান তখন অনন্তের বাসার হয়ে ছিটকে পড়েন।

নীল ঝর্ণা হলুদ সাঁকো: আব্দুল বাসার খান, কাঞ্চিদেশ প্রকাশনী, রামপুরহাট বীরভূম, প্রচ্ছদ: অঞ্জন দুবে, মূল্য: ৭০ টাকা।

.png)
.png)
Post a Comment