বই রিভিউ

 

webtostory

জীবনকে যখন অবিকৃত রূপে দেখেন গল্পকার

🌴

 তৈমুর খান 

  🌱

 বীরভূম যখন বাংলা ছোটগল্পের ক্ষেত্র— স্বাভাবিকভাবেই তখন বীরভূমের জনজীবন, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, জীবন সংগ্রাম, কূটকৌশল, প্রেম ও যৌনতা, পাথর খাদান, জাতীয় সড়কের ধারে ধাবায় দেহ বিক্রি, বাংলাদেশের সঙ্গে রোডের সংযোগ এবং গরু পাচার—কত কিছুরই না প্রসঙ্গ এসে যায়। পাথুরে মাটি বীরভূমের এক ফসলী জমি, কর্মহীন মানুষের দুঃখ দারিদ্র, অভাব অভিযোগ, এবং সাম্প্রতিককালের পট পরিবর্তনের ছবি সবই গল্পের বিষয় হয়ে ওঠে।


কথাশিল্পী শ্রীকান্ত অধিকারী এই মাটির সঙ্গে মিশেই তুলে এনেছেন গল্পের রসদ আর তা খাঁটি সোনার মতোই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে 'হাঁসের পালক'(প্রথম প্রকাশ মার্চ ২০২১) গ্রন্থে। খুব বাস্তব জীবনবোধ এবং তীক্ষ্ণদৃষ্টি সম্পন্ন বলেই লেখক জীবনের উত্তাপ ও অন্ধকারকে একই সঙ্গে সাবলীলভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন। গল্পগুলি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে: এ তো আমাদের চোখে দেখা জীবন, এ তো আমাদেরই মুখের ভাষা।


তারাশঙ্করের পরবর্তী যে ক'জন গল্পকার বীরভূমের জনজীবন নিয়ে গল্প লিখেছেন তাঁদের মধ্যে থেকেও শ্রীকান্ত অধিকারী ভিন্নপথ অবলম্বন করেছেন। সেই পথটি পরিবর্তনশীল গ্রামজীবনের অভিমুখ। যেখানে কৃষিব্যবস্থার জলসেচন পদ্ধতি, মাটির নিচের খনি উত্তোলন এবং নতুন ফ্যাক্টরি, পাথর খাদান এর শ্রমিক বৃত্তি, যৌনব্যবসার নতুন কৌশল, বিবাহ সম্বন্ধের পরিবর্তন, গরু পাচারের কাহিনি, শোষক-শোষিতের রূপ পরিবর্তন, পৈতৃক পেশায় কিশোর বয়সেই ব্রাহ্মণ ছেলের পুরুত হয়ে ওঠা ইত্যাদি সব কিছুরই সমাবেশ ঘটেছে।


চরিত্রের সংলাপগুলিতে বীরভূমের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারও যথাযথ। আবার খাদান অঞ্চলের সাঁওতাল জীবনযাত্রার সঙ্গে তাদের উচ্চারিত ভাষারও যথাযথ ব্যবহার করেছেন। কোনো গল্পেই বাস্তবতাকে অতিক্রম করেননি, বরং জীবনের স্বাভাবিক গতিকেই স্বাচ্ছন্দ্য দান করেছেন।


 মোট ১৩ টি গল্প আছে এই গ্রন্থে। নিষ্ঠুরতা, আদিমতা নিয়েই গল্প গুলির বিকাশ। আবার নিদারুণ হা-হুতাশও ফুটে উঠেছে। 'হাঁসের পালক' গল্পে পাত্রী দেখতে এসে পাত্রের মা কান চুলকানোর জন্য একটা হাঁসের পালক আনতে বলে। বাড়ির ছোট ছেলে পালক আনতে গিয়ে পুকুরে তারস্বরে হাঁসকে ডাকে: 'তি তি তি তি তৈ তৈ তৈ তৈ…' এই ডাকটার ভাষাটি বীরভূমের সর্বত্রই প্রচলিত। লেখক এটি এড়িয়ে যেতে পারেননি। 'নষ্টামি' গল্পে গ্রাম বদলে যাওয়া, কৃষি-আবাদ বদলে যাওয়া, জল চুরি করার কৌশল এবং পাম্প পাহারা দেওয়া কিশোরের যৌনাকাঙ্ক্ষা দেখানো হয়েছে।


সেইসঙ্গে হাইরোডের ধারে গজিয়ে ওঠা পেট্রোল পাম্প ও ধাবায় অনৈতিক কারবারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। লেখক এর বর্ণনায়: 'উনিশ বছরের পুরুষাঙ্গ কখন কঠিন হয়ে হাজার হাজার ঘূর্ণনের জন্য তৈরি হয়ে ওঠে। মাথার পিছনটা যত টস টস করে ততই শক্ত পুরুষাঙ্গে হাত বোলাতে ইচ্ছে করে। এক মুহূর্তে কচি আলুপাতার গন্ধ-শব্দ পাম্পসেট নদীর জল মরা-বালির চর অন্ধকার-ভয়-ভালোবাসা সব তালগোল পাকিয়ে ষোলো বছরের ডাগর ডাগর ডলি হয়ে দাঁড়ায়।' এই যৌনতাও তখন স্বাভাবিক প্রবৃত্তিরই জাগরণ বলে মনে হয়।


'দখিনা বায়' গল্পে ৬০নং জাতীয় সড়ক গরু পাচারের লিংক হিসেবেই উঠে আসে। 'চুপচাপ মাল ডেলিভারি দিয়েই' ড্রাইভারদের ফিরতে হয় শুধু টাকার জন্য। পাথর খাদান থেকে লরি লরি পাথরও চলে যায় । জলাজমিতে কারখানার পত্তন হয়। পুরুষ-মহিলা পাথর খাদানে কাজ করতে যায়। গল্পটি একটা উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠে। অন্যান্য গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: 'শিব যখন রাস্তায় নামে' গল্পে ভক্তদের সুলতানগঞ্জ থেকে গঙ্গাজল নিয়ে দেওঘর যাওয়ার পথে রাস্তার দু'পাশে স্থানীয় গরিব মানুষদের কড়ি সংগ্রহের তাগিদ দেখা যায়।


তাদের ছোট ছোট শিশুকে শিব সাজিয়ে হাত পেতে ভিক্ষা চাইতে পাঠায়। 'মরিরামের ভেলা' গল্পে বীরভূমের পরিচয়টিই বড় হয়ে ওঠে। খাদানে জমি গ্রাস করছে। জমি রক্ষা করার তাগিদ দেখা দিয়েছে। 'পাথুরে বিষ' সাঁওতালি উচ্চারণের কথোপকথনে এমনকি গল্পকারও এই ভাষাতেই গল্পটি রচনা করেছেন।


পাথর খাদানে কিভাবে পাথর ফাটানো হয় সেই ডিনামাইটের শব্দ শুনতে পাই গল্পে। শ্রমিকদের জীবনযাত্রা তাদের কার্যক্ষেত্রে পাথরের ধুলো-বিষে কতটা তারা জর্জরিত তা উপলব্ধি করা যায়। শহরের মানুষ এই জীবনের কথা জানে না। 'একটা পেঁপে গাছ ও  যাদবলালের স্ত্রী' গল্পে কিভাবে জীবনের স্বপ্নকে রক্ষা করা যায় সেই সংগ্রামের গল্প। মর্মকে স্পর্শ করে এই গল্পে।


'লেজুড় বৃত্তান্ত', 'যখন কান্না হারিয়ে যায়', 'নিজের ঘর' এবং 'ছোটাপুরুত' প্রভৃতি গল্পগুলিও আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে। তত্ত্বকথা নয়, রাজনীতি নয়, কল্পনা নয় জীবনের নিষ্ঠুর সত্যটি কতখানি মারাত্মক, দারিদ্র্য এবং হতাশার মধ্যে বেঁচে থাকার টানাপোড়েন কতখানি জীবন্ত এই গল্পগুলিতে তারই পৌনঃপুনিক উচ্চারণ ফিরে এসেছে। শ্রীকান্তের তারিফ এই কারণেই করতে হয়: তিনি জীবনকে অবিকৃত রূপে দেখতে জানেন; তিনি জীবনের দীর্ঘশ্বাস খুব কাছ থেকে শুনতে পান। যা সত্য, যা অব্যর্থ, যা বাস্তব তিনি তাকেই লিখতে জানেন। তিনি ছলনা জানেন না।



   🦆🦆🦆

 হাঁসের পালক: শ্রীকান্ত অধিকারী, একটি সৃষ্টিসুখ প্রয়াস,৩০এ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০৯, প্রচ্ছদ পার্থপ্রতিম দাস, মূল্য ১৩৯ টাকা।